নদী সিকস্তির মতোই কি তিনি হারিয়ে যাবেন? মওলানা ভাসানীর রাজনীতির গন্তব্য কোথায়

37

 

নদী সিকস্তির মতোই কি তিনি হারিয়ে যাবেন?
মওলানা ভাসানীর রাজনীতির গন্তব্য কোথায়?
মো. মাহবুব উল আলম
১. প্রশ্নটা উঠেছিল সেই ১৯৫০-এর দশকের শুরুতেই। যখন মওলানা ভাসানী তৎকালে দ্রæত গতিতে বেড়ে উঠতে থাকা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী মিত্র জোটের বিরুদ্ধে ঝড়ো ঈগলের মতো সোচ্চার। ঐ সময়ে তাঁর মরমিয়া সাথী হিসেবে পেয়েছিলেন মহান দার্শনিক লর্ড রাসেল, খোদ চার্চিল সরকারই যাকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের কারণে। প্রথমে ফরাসী ঔপনিবেশিক দৈত্য এবং এর পরপর তৎকালীন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অক্টোপাসের হাতে ভিয়েতনাম তথা সমগ্র ইন্দো-চীনের রক্তক্ষরণকালে মওলানা ভাসানী ও লর্ড রাসেলকে যুদ্ধের বিপক্ষে, শান্তির সপক্ষে একসাথে দেখা যায়। তদানীন্তন পাকিস্তানে গণতন্ত্র সংহারক ভূমিকায় অবতীর্ণ মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার, ‘গুলীর রেঞ্জের’ বহু বাইরে মওলানা ভাসানী তখন লন্ডনে বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় গণতন্ত্রবাদী উদারপন্থী বিশ্বনেতা, শ্রমিক নেতা, সাংবাদিক, দার্শনিক, প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিক শিল্পীগণ পরিবৃত অবস্থায় নয়া দুনিয়ার ধল্-পহরের আবির্ভাব রচনায় নিমগ্ন। সেটা ১৯৫৪ সনের কথা। বহির্বিশ্বের পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে ‘মিঃ মুলানা অগ্নিবর্ষী, পূর্ব আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, সংগ্রামী জনতার প্রত্যাশার মূর্তপ্রতীক, কমিউনিস্ট সাম্যবাদী লাল মুনালা কিম্বা ইসলামী সাম্যবাদের এক নতুন প্রেরণা!’ কতো তাত্তি¡ক ও সমাজতাত্তি¡ক বিতর্ক তাঁকে নিয়ে! ১৯৮০ সনে তাঁর জন্মশত বার্ষিকীতে প্রকাশিত এক সমৃদ্ধ ম্যাগাজিনে কৃষক সংগ্রাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ‘মওলানা ভাসানী কি বিতর্কিত’ শীর্ষক এক তথ্যবহুল নিবন্ধের উপসংহারে বলেন যে, তিনি একটা অদ্ভুত ও নতুন দর্শন ও রাজনীতির ধারক বাহক ছিলেন, যা এখনো প্রচলিত রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি, অথবা রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞানের অভাব ছিল!… তাঁর রাজনীতির দর্শন অঙ্কিত ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ক্যানভাসে এবং তা ছিল, সাধারণ মানুষ যেন ‘মানুষের মতো’ বাঁচতে পারে। ‘আমি গোটা দুনিয়ার জালেমদের বিরুদ্ধে এবং মজলুম মানুষের পক্ষে আছি।’ তাঁর রাজনীতির ময়দান সারা পৃথিবীময় বিস্তৃত। তাঁকে নিয়ে গবেষণার শুরু হলেও গন্তব্য অনেক দূর।’
২. মওলানা ভাসানীর রাজনীতির গতি ধারা অনুধাবন করতে হলে শুরু করতে হয় মানব সমাজের ইতিহাসের গোড়া থেকে। হযরত আদম (আ.)-এর পর থেকে মানব সমাজ পরিবারতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, গোত্রতন্ত্র, দাসতন্ত্র ও সে প্রথার বিরুদ্ধে ফেরাউনী আমলে হযরত মুসার (আ.) ব্যবস্থাপনায় সফল প্রতিরোধ দেখেছে। এর বহু পর হেলেনিক যুগে এলো সমাজ বিন্যাস ও ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে প্লেটো-এ্যারিস্টটলের তত্ত¡। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ সংলাপে কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি ‘দাসদের শ্রম।’ এ্যারিস্টটল স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন না করলেও গ্রীসের দাস-ভিত্তিক নগর গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। হযরত ঈসা (আ.) সুদ ও লগ্নি পুঁজি ভিত্তিক শোষণমূলক অর্থনীতির বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ প্রদর্শন করে নিগৃহীত হয়েছিলেন। হযরত মোহাম্মদ (দ.)-এর নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই তাঁর পরিবারে কেতাবীভাবে নয়, কার্যকরভাবেই দাসপ্রথা বিলোপন প্রক্রিয়া শুরু হয়, যখন তাঁর পিতা আবদুল্লাহ বালিকা গৃহকর্মী উম্মে আয়মানকে বাজার থেকে ঘরে আনলে মা আমেনা তাকে মুক্ত করে দেন, যিনি আজীবন নবী পরিবারের মর্যাদা সম্পন্ন সদস্যা হিসেবে বিরাজ করে বহু কর্ম নিস্পন্ন করতেন। মা খাদীজার (র.) ভ্রাতুষ্পুত্র তাঁর জন্য দাস হিসেবে জায়েদ বিন হারিসাকে কিনে আনলে মা খাদীজা (র.) ও নবীজী (দ.) সাথে সাথেই তাঁকে আযাদ করে দেন। এর পরেই ইতিহাস নবী জীবন ও সমাজ ব্যবস্থার সর্বস্তরে দাস প্রথা, শ্রমদাস প্রথা বিলোপের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ইতিহাস, যা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সহজ ভাষায় বিবৃত আছে। পরবর্তীতে বাণিজ্য অর্থনীতির যুগ পেরিয়ে যন্ত্র শিল্প নির্ভর শিল্প অর্থনীতির জমানা প্রবর্তিত হলে শোষণ ও স্বৈরাচারের যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তার বিরুদ্ধে স্যার টমাস সূরের মতো মানুষের অগ্রগামিতায় সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধের মেঘ জমতে থাকে। ইউরোপে যাজকতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ও যন্ত্রশিল্পজাত পুঁজিবাদী শোষণ জাল বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং তাদের শিল্পজাত পণ্যের বাজার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এশিয়ার আমেরিকায় ঔপনিবেশিক দখলদারী প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। ফ্রান্সে সংঘটিত হয় ফরাসী বিপ্লব, যা ৭১ দিনের মধ্যে ছত্রখান হয়ে যায়। ইউরোপীয় রেনেসাঁর সুফল অধিকাংশ গিয়ে পড়ে বুর্জোয়া বিপ্লবের ঝুড়িতে। ইউরোপে শ্রমিক শ্রেণীর দুর্দশা মার্কসীয় সমাজতত্তের ভিত্তি স্থাপন করে। বহু সংজ্ঞায় বিভূষিত সমাজতন্ত্র মার্কসের হাতে নতুন তাত্তি¡ক অবয়ব লাভ করে। অর্থনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, রাষ্ট্রতত্ত¡ প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তিত ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় “শ্রমিক শ্রেণির” রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কিন্তু অল্পকাল পরেই সেই পুরানো শ্রেণি শোষণ ও শ্রম শোষণ নতুনরূপে আবির্ভূত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি কার্যতঃ ছত্রখান হয়ে যায়।
৩. মওলানা ভাসানী তাঁর স্বদেশ বাংলা দেশ-ভারতবর্ষে এই সামাজিক রাজনৈতিক বিবর্তনের প্রত্যক্ষদর্শী পরিবর্তনের প্রত্যেক স্তরের সাথে কোন না কোনভাবে সংশ্লিষ্ট। সামন্ততন্ত্র, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্রের নামে নির্মম চাপাবাজী প্রভৃতির প্রত্যক্ষদ্রষ্টা ও শিকার তিনি নিজে। কৃষক শ্রেণির ভোটে ১৯৪৬ সনে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে কৃষকদের দুর্দশা নতুনভাবে বাড়তে থাকে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনীতিকে কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির প্রকাশ্য প্লাটফরম ভিত্তিক গণতান্ত্রিক মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ সদ্ব্যবহার করতে গেলে ১৯৫৬-৫৭ সনে একশ্রেণির বাম-ডান ও মধ্যশ্রেণির অঘোষিত জোট সেই কর্মসূচি বানচাল করে দেয়। ইতোমধ্যে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্যাতনের অবাস্তবায়িত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য তিনি নতুনভাবে সংগ্রামের পত্তন করেন। সেখানেও বারে বারে বিপত্তিগ্রস্ত ও বাধাপ্রাপ্ত হন। সেটা আরেক ইতিহাস। প্রত্যেক দশকেই তিনি স্বার্থবাজ চক্রের বাধা ও বিকৃতির শিকার হল নির্মমভাবে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি গত শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে আমৃত্যু প্রত্যেক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। কৃষকদের নিয়ে তাঁর সফল রাজনীতির ফলশ্রæতিতে ১৯৩৫ সন থেকে ১৯৫৫ সন পর্যন্ত অনেক কৃষকবান্ধব আইন প্রণীত ও প্রবর্তিত হয়। কিন্তু তার ভাষায় এসব পরিবর্তনে গণমানুষের প্রকৃত কল্যাণমূলক পরিবর্তন আসেনি। ‘মানুষকে মানুষের মতো বাঁচতে দেবার’ সামাজিক-অর্থনীতিক পরিবেশ আসেনি, যা এখনো সুদূর পরাহত। সেই গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে দাসতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র, বুর্জোয়া গণতন্ত্র, দৃশ্যমান সমাজতন্ত্র-প্রভৃতি সামাজিক পদ্ধতির প্রতিকারহীন ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বিশ্ব মানবিক পরিসরে সার্বজনীন এক আদর্শের তত্ত¡ পেশ করেছেন ভবিষ্যতের ইতিহাসের জন্য; যেটাকে তিনি তার অভিজ্ঞতার সার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই সারমর্ম তিনি তৈরি করেছেন মানব সমাজের জ্ঞাত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা এবং কোরআনে বিবৃত মানবজাতি ও জগতের প্রকৃতির রাষ্ট্রনৈতিক রসায়নের মাধ্যমে। এর নাম তিনি দিয়েছেন-পালনবাদ, যার সংজ্ঞা তাঁর ভাষায়; ‘পালনবাদ বিশ্বব্রহ্মান্ডর একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান। ইহা কোন ধর্মের কথা নহে। মুসলমানদের জন্য তিনি সৃজন-পালন-বিবর্তনকর্তা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আস্তিক-নাস্তিক সবার জন্য তিনি একই বিধানে আলো হাওয়া, জল-ফল-পানি-বস্ত্র-খাদ্য সবই যোগাইতেছেন।.. মানুষের শাসনবাদ নহে, স্রষ্টার পালনবাদী আদর্শই মানুষে-মানুষে শাসন- শোষণ ও হানাহানি বন্ধ করিয়া ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া মানবজাতিকে সুখী করিতে পারে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোন দেশের প্রশাসনিক। বাণিজ্যিক, শিক্ষাগত, ধর্মীয় প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে বান্দার স্বাভাবিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হক্্ বুঝাইয়া দেওয়াই পালনবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রথম শর্ত।” বিশ্ব মানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ রকম পরিবেশেরই অপেক্ষায় রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় কোন শেষ নেই। সৃজনশীলভাবে এই বিবর্তনের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে। নদী সিকস্তির মাটি কখনো হারিয়ে যায়না। একদিকে ভাংলে অন্যদিকে গিয়ে জমে। তাঁর রাজনীতিক পরম উপলব্ধি কোন না কোন রূপ পরিগ্রহ করে শ্রেণি-স্বার্থভিত্তিক দলনীতির স্রোতের প্রতিকূলে চলবে এবং মানব জাতির অন্তর্জাত প্রত্যাশা পূরণের অবলম্বন হিসেবে বিরাজ করবে। মওলানা ভাসানীর রাজনীতির গন্তব্য এটাই।
পানি নিয়ে বিশ্বময় ক্রমবর্ধনশীল সঙ্কট তাঁর চোখে ধরা পড়েছিল ১৯৬০-৭০ এর দশকেই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে সতর্ক করার লক্ষ্যে আয়োজিত ফারাক্কা মহামিছিল শেষে ১৯৭৬ সালের মে মাসের শেষ দিকে সন্তোষে অনুসারীদের ব্যাকুল জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, তোমাদের সামর্থমতো তোমরা কাজ করে যাও। আমার অসমাপ্ত কাজ করার যথার্থ ক্ষমতা যাদের হবে, তারা সময় মতো আসবে। ইতিহাসের প্রগতিশীল বিবর্তনের উপর তাঁর দার্শনিক আস্থা। অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কাল স্রোত তাঁর পায়ে পায়ে চলেছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও গবেষক