নতুন শিক্ষাক্রমের ঝুঁকি কাটিয়ে উঠা কতটুকু সম্ভব?

40

অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব

শিক্ষা হল একমাত্র সবচেয়ে সহজ ও সর্বজনীন পথ ‘মানুষ’ হয়ে উঠার। মানুষের ভেতরের সুপ্ত মেধা-মননকে জাগিয়ে তোলার ও সক্রিয় করার ‘জিয়ন’ কাঠি শিক্ষা। শিক্ষা জ্ঞান না হয়ে একটি প্রক্রিয়া হওয়ায় সেই প্রক্রিয়াকে ভাল করে জানায় ও প্রায়োগিক দক্ষতায় রয়েছে শিখন-শেখানোতে সফলতা। অনেকটা চিকিৎসকের দক্ষতা ও প্রজ্ঞতার মত। তাই দরকার হয় তার সঠিক কলাকৌশল জানা ও পরিবর্তিত আসময়ের চাহিদা পূরণে এইসব প্রায়োগিক কলাকৌশল পরিবর্তন করা। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর কালিক চাহিদা বিবেচনা করে শিক্ষক্রম পরিবর্তন করতে হয়। এই ধারাবাহিকতায় প্রণয়নকৃত নতুন ও পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে এবারে শিক্ষার কলা কৌশলকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছে তেমনি শিক্ষার্থীর সক্রিয়তাকেও। আগের ব্যবস্থায় দেখা যায় শিক্ষক বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থী শুনে যাচ্ছে। এই শোনাতে শিক্ষার্থীর আগ্রহ, প্রবণতা, ব্যক্তিত্ব, ইত্যাদির তেমন গুরুত্ব থাকত না। ফলে শিখনে জটিলতা দেখা যেত। সক্রিয় করণে তেমন সফলতা দেখা যেত না। যা যেত তা সনদ কেন্দ্রিক, পরীক্ষা কেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ তথা কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হয়েছে কিনা তা বিবেচনায় আনার সুযোগ ছিল না। এবারে শিক্ষার ক্ষেত্রকে দাপ্তরিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিষ্ঠানের বাইরে, পরিবারে, সমাজে ও শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতার নানা বিচিত্র ক্ষেত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যাতে শিক্ষার্থী নিজস্বতায় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তা পরিশোধিত করে নিজের সক্রিয়তায় তা জ্ঞানে পরিণত করতে পারে। আবার নিজের মধ্যেও কাক্সিক্ষত আচরণিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে ও সময় উপযোগী দক্ষতা অর্জন করতে পারে। যেহেতু দক্ষতা চর্চার বিষয়, চর্চা বা অনুশীলন করে তা অর্জন করতে হয়। তার ধারাবাহিকতায় টিকে থাকার অনুকূল ‘জলবায়ু’ নিশ্চিত করতে হয়। যা করতে হয় পারিবার, রাষ্ট্র ও সামাজকে। এই সবের নানা প্রেক্ষিত থেকে জ্ঞান অর্জন হয়, যা একটি মানসিক প্রক্রিয়া। তাই এখানে সফলতার জন্য শিখন-সেখানো প্রক্রিয়ার সময়োপযোগী দক্ষতা যেমন লাগে তেমনি তার অনুকূল পরিবেশও লাগে। পরিবেশকে আমরা শিক্ষার ‘জলবায়ু’ বলে বিবেচনা করতে পারি। জলবায়ুর আনুকূল্যের উপর যেমন ফসলের ফলন নির্ভর করে তেমনি শিক্ষায় সফলতা নির্ভর করে শিক্ষাকেন্দ্রিক পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ এর অভিভাবক ও শিক্ষকদের মানসিক প্রস্তুতি ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর । সেই প্রস্তুতি ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে না উঠা পর্যন্ত নতুনভাবে প্রণয়নকৃত শিক্ষাক্রমের তথা লক্ষ্যমুখী রোডম্যাপের যাত্রায় সহজে সফলতা আসবে না। এখন নতুন কারিকুলামে বলা হচ্ছে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষা অর্জন করা। যে শিক্ষা অর্জনে শিক্ষক শুধু সহায়ক বা কোচরূপে থাকবেন। আর শিক্ষার্থী থাকবেন সক্রিয়। এই ধরনের শিক্ষার কৌশলের মূল কথা হচ্ছে শিক্ষার্থীকে তার নিজের পরিবেশ, নিজের সমস্যা ও নিজের আগ্রহের জায়গা থেকে অভিজ্ঞতা লাভের একটি বিষয়, প্রেক্ষিত বা প্রেক্ষাপটের মুখোমুখি করা। যাতে শিক্ষার্থী তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে ভাবতে পারে। বর্ণনার সুবিধার জন্য শেখানো প্রক্রিয়ায় যেটাকে আমরা প্রথম ধাপ বলতে পারি। অভিজ্ঞতার এই প্রথম ধাপে প্রেক্ষাপট হতে অর্জিত অভিজ্ঞতা পরিশোধিত করে তা জ্ঞানে রূপান্তর করা শিক্ষকের দায়িত্ব না, তার জন্য শিক্ষক হলেন নির্দেশক বা পরামর্শকমাত্র। শিক্ষার্থীর নিজের সক্রিয়মূলক কাজ দিয়ে তা জ্ঞানে রূপান্তর করবে। অন্য কথায় শিক্ষার্থী ফুটবল মাঠে খেলবেন শিক্ষক বা কোচের নির্দেশনা অনুযায়ী। গোল তৈরী করবে শিক্ষার্থীরা গোল দিবেনও শিক্ষার্থীরা। কোচের মাঠে নামার সুযোগ নেই। অনেকটা সেই রকম। যেমন উদ্ভিদবীজের উদগম, উদগমিত ভ্রূণ চারা হয়ে উঠা। সে চারা গাছে পরিণত হওয়া,গাছে ফুল হওয়া,ফুল থেকে ফল হওয়া,সেই ফলের বীজ হতে আবার ভ্রূণ হওয়া, এক কথায় উদ্ভিদের জীবন চক্রের উপর বক্তৃতা না দিয়ে তার পরিবেশের একটি গাছ (কৃষি এলাকা বা পরিবারের শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ধানের বীজচারা) তার সামনে বা মুখোমুখি করা। সময় বিবেচনা করে ধান গাছের জীবন চক্রের চার্ট বা পোস্টার তার সামনে তুলে ধরা। শিক্ষার্থী তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সেই চার্টে ধানগাছের জীবন চক্রের মিল খুজঁবে। এতে তার মানসিক সক্রিয়তা গড়ে উঠবে। তার পরিবেশ (কৃষি এলাকা), পরিবেশের উপাদান (ধানচারা), উপদানের পরিবর্তন (জীবনচক্র) ইত্যাদির সাথে তার মনোসংযোগ স্থাপন হবে, আগ্রহ তৈরী করার মাধ্যমে শেখানোর প্রথম ধাপ শেষ বলা যায়। তবে এই প্রথম ধাপের বড় চ্যালেঞ্জ হল শিক্ষার্থীর আগ্রহ-প্রবণতা অনুযায়ী অভিজ্ঞতার বিষয় বাছাই করণে শিক্ষকের দক্ষতার পরিচয় দিতে পারা।
২য় ধাপে ধানের চারার জীবন চক্রের ধারাবাহিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো অনুধাবন করা ও তার সম্ভাব্যতা দেখা। শ্রেণি ও বয়স ভেদে তার বিশ্লেষণের মাত্রা নির্ধারণ করার দিকে সচেতন থাকা। ২য় ধাপের চ্যালেঞ্জ হল ধানের চারার মত সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনচক্র থাকে এবং সে জীবন চক্রেও গুনগত ও পরিমান গত পরিবর্তান করা যায় বা পরিবর্তন হয়ে আসছে তা আত্তীকৃত করাতে পারে। তার সাথে ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত পরিবর্তনে বেঁচে থাকতে পারার জন্য অভিযোজিত বা খাপ খেয়ে নিতে গিয়ে তাতে বিবর্তন হয়ে আসছে তা অনুধাবনে আনতে পার। ৩য় ধাপ হল, ধানের ধারাবাহিক পরিবর্তন হওয়ার সম্পর্কে সচেতন হওয়া। অর্থাৎ জীবনচক্রের অনুকূল ও প্রতিক‚ল অবস্থা ও জীবনচক্র সম্পন্ন হতে পারার প্রয়োজনীয় উপাদানের বিষয়ে জানার আগ্রহ তৈরি করা। এই ধাপে শিক্ষার্থীর কৌতূহল এর বিস্তৃতি ঘটে। এখানে সৃজনশীলতা প্রকাশ করার সুযোগ থাকে। চারা উদগমের সময় আলো, পানি, তাপ সবকিছু কি একসাথে লাগে, নাকি দুই একটা না হলেও চলে। আবার কোন একটার পরিমান বাড়ালে বা কমালে জীবন চক্রে কি ধরনের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে ইত্যাদি জানার ও ভাবার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া। ৩য় ধাপের চ্যালেঞ্জ হল, ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতার জগতের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিত বা বিষয় শিক্ষার্থীর সামনে দেয়া সম্ভব করা। যাতে শিক্ষার্থীকে বেশি সক্রিয় করা সহজ হয়। তার জগতের সমস্যার বিষয় তাতে জড়িয়ে দিতে পারা। এই যে ধানের জীবনচক্র ও চক্রের সংশ্লিষ্ট নানা উপাদান ও তার প্রভাব কিভাবে মানুষের কল্যাণে লাগানো যায়, কল্যাণে আরও বেশি লাগানোর জন্য তাতে কী কী পরিবর্তন আনা যায় তা নিয়ে মতামত দেয়া সক্ষমতা অর্জন করানো । এতটুকুতে যা অভিজ্ঞতা হল, জানল ও ভাবল তা আরও পরিশোধিত হয়ে সঠিক জ্ঞানে পরিণত করার জন্য শেষ বা চতুর্থ ধাপে যা শিক্ষার্থীকে করতে হবে তা হল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। ৪র্থ ধাপের চ্যালেঞ্জ হল, শ্রেণি উপকরণ এর পর্যাপ্ততা,পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার উজ্জীবিত ও প্রেরণামূলক তদারকি ও পরামর্শ দেয়ার সময় ধৈর্যশীল থাকতে পারা।
শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতার আলোকে এই সক্রিয়তায় ধানের জীবন চক্র সম্বন্ধে জানাই শুধু প্রধান উদ্দেশ্য ধরে নিলে বর্তমানে প্রণয়নকৃত নতুন কারিকুলামের কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে যাবে, অকার্যকর হয়ে যাবে। এই বিষয় ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তার পরিবেশের নানা উপাদান ও ঘটনা বিষয় নিয়ে তাকে ভাবার ও জানায় ঔৎসুক্য করে তুলাও লক্ষ্য। সেই অভিজ্ঞতায় দেখার দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত দেয়া ও সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবনা দিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা তৈরি হওয়া ও করানো অন্যত্ম লক্ষ্য।
এভাবে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শ্রেণি ও বয়সের যোগ্যতা ভিত্তিক দক্ষতা অর্জিত হলে সেই জ্ঞান বোঝা হয়ে না উঠে সম্পদ হয়ে উঠবে। তা আত্তীকৃত বা নিজস্বকৃত হয়ে জগতকে জানার, বোঝার অদম্য ইচ্ছাশক্তি জেগে উঠবে। আপন নিজস্বতায় নিজের ধারণা ও অবস্থান টের পাবে বলে তার জ্ঞানতৃষ্ণা বেড়ে যাবে, তার ভেতর জ্ঞানের অভাব বোধ বেড়ে যাবে। নিজেকে আরও দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে তাড়না অনুভব করবে। এখানেই এই কারিকুলামের বিশেষত্ব। আমাদের এত বছরের শিক্ষকতা ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় বলব নতুন কারিকুলাম ও পদ্ধতিটি শিক্ষার গুণগত মানের উপযোগী। কিন্তু তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি কেমন তা বাস্তবায়নে সাধারণ বাঁধগুলো কী কী তার উপরও দৃষ্টিপাত করা যায়।
১. পুরানো ধাঁচের মানসিকতা বা জাড্যতায় বৃত্তাবদ্ধ থেকে যাওয়ায় শিক্ষা ও জ্ঞানকে একই ভাবার বৃত্ত থেকে বাইর হতে না পারা। ২. শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব ও মননের গঠন মানের বিচ্যূতি গড়মান হতে বেশি হওয়ায় শিক্ষককে শ্রেণিকার্যক্রমে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া। ৩. শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারে অদক্ষতা ও অপ্রতুলতা। ৪. প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি। ৫. প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে শিখন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় রাখায় ও বিষয়মুখি একাগ্রতায় রাখতে না পারা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আনুপাতিক সংখ্যা বিবেচনায় ক্লাসে শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি হওয়া। ৬. শিক্ষার্থীর মেধা ও মনন গড়ে উঠার অন্যতম দুটি উপাদান হল পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও স্কুল পাঠাগার। তা দিন দিন সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়া।
এসব বাঁধা কাটিয়ে উঠতে পারলে নতুন পদ্ধতি কার্যকর করা ফলপ্রসূ হবে। তার জন্য ঝুঁকিগুলো কাটিয়ে উঠার দ্রæত ব্যবস্থা নিতে হবে। এই জন্য শিক্ষাবাজেট বাড়াতে হবে। সুষ্ঠু নজরদারি ও মনিটরিং এর মাধ্যমে সেই ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন ও ভাল কিছুর চিন্তা-চেতনার ধারক হল সমাজ। সেই সমাজের শিক্ষার নতুন পদ্ধতির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তার জন্য শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী নিয়ে সামাজিক দায়িত্ব হিসাবে নতুন কারিকুলামের পক্ষে মতামত তৈরিতে কাজ করে যেতে হবে। এই ব্যাপারে মানসিকতা তৈরী করতে হবে। নতুন কিছুতে সব চাহিদার প্রতিফলন থাকে না। ঘাটতি ও অসঙ্গতি কিছু না কিছু থাকতে পারে। বৃহত্তর স্বার্থে তা যথার্থভাবে পরিমার্জন ও সংশোধন করে নিতে হবে। তার জন্য সময় লাগতে পারে।
আলোচনা, সমালোচনা ও মতামতের ভেতর দিয়ে নতুন কিছু টিকে থাকে ও বিকাশলাভ করে। আমাদের গুণগত শিক্ষা লাভের জন্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে তা কার্যকরের পথে আমাদের সক্রিয় থাকার পাশাপাশি ও গঠনমূলক সমালোচনা ও মতামত দিয়ে যেতে হবে, সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ- খলিলুর রহমান মহিলা (ডিগ্রি) কলেজ