নতুন বছর মানে প্রতিবছর হৈ চৈ, নতুন আশা রাজনীতিতে সমঝোতার প্রত্যাশা

22

তুষার দেব

নতুন বছর মানে প্রতিবছর হৈ চৈ, নতুন আশা। কালের পরিক্রমায় আরও একটি বছর বিদায় নিল; হারিয়ে গেল মহাকালের গর্ভে। গতকাল শনিবার পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হয়েছে বিদায়ী বছরের শেষ সূর্য। আজ রবিবার থেকে যাত্রা শুরু হল ইংরেজি নতুন বছরের। প্রকৃতির নিয়ম মেনে আজ সকালে পূর্বাকাশে যে সূর্যোদয় ঘটেছে, সেটি নতুন বছরের। তাই সাফল্য-ব্যর্থতার অতীতকে পেছনে ফেলে এখন নতুনকে স্বাগত জানানোর পালা।
স্বাগত ২০২৩। নতুন বছর মানে আগামীর পানে নবযাত্রা। হ্যাপি নিউ ইয়ার। বাঙালি জাতির জীবনে গ্রেগরিয়ান নববর্ষ উদযাপনের রীতি-রেওয়াজ বৃটিশ শাসনামল থেকেই অনুসৃত হয়ে আসছে। কালের পরিক্রমায় সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তার ধরন ও পরিসর বেড়েছে বৈকি। এবারের ইংরেজি নতুন বছর ২০২৩ সাল জাতীয় জীবনে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ বছরই ক্ষমতাসীন সরকারের শাসনামলের শেষ বছর। বছরের শেষ কিংবা পরবর্তী বছরের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হবে বহুল কাঙ্খিত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। এছাড়া নতুন বছরে সামনে আসা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পাশাপাশি জাতীয় অগ্রগতি ও অর্জনের খাতায়ও নতুন পালক যুক্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা বিদ্যমান রয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তকরা বলছেন, ২০২৩ সালে নানামুখি ধাক্কা সামলে নেবে বাংলাদেশ- এমন প্রত্যাশা সকলের। মহামারি করোনায় বৈশ্বিক বিপর্যয়ের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংকট তৈরি হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিশেষত খাদ্য ও নিত্যপণ্যের বাজারে চলছে চরম অস্থিরতা। ২০২৩ সাল সারা বিশ্বের জন্যই মন্দা কাটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশকেও এই মন্দা মোকাবিলা করতে হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে কীভাবে সম্ভাব্য কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে, তার ধারণাও দিয়েছেন তিনি। এই মন্দা অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের। বিশ্বের বড় বড় ধনী দেশেও এই মন্দা দেখা দেবে বলে মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে তারা যত সহজে তা মোকাবিলা করতে পারবে, আমরা তা পারব না। সেজন্যই এখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভেবেচিন্তে সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। জাতীয় জীবনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক লড়াইও রয়েছে। দেশে ক্ষমতার পালাবদলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুখকর হয়নি কখনও। তাই ধারণা করা হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী শিবিরের অনড় অবস্থা তথা কেউ কাউকে ছাড় না দেয়ার মানসিকতা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। গণমানুষের প্রত্যাশা, এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলসহ সকলকে জননিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির নামে জনদুর্ভোগ যাতে না হয়, সেদিকে সবপক্ষকেই খেয়াল রাখতে হবে। আর সরকার ও প্রশাসনকে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। তা না হলে বৈশ্বিক মন্দার সঙ্গে দেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতা সঙ্কটকে আরও ঘনীভ‚ত করবে। বিশ্বজুড়ে একযোগে মন্দা খুব একটা দেখা যায় না। দীর্ঘ সময় পর করোনাকালে যুগপৎভাবে মন্দা দেখেছে বিশ্ববাসী। সারা বিশ্বের স্থিতিশীল অবস্থা করোনা এসে তছনছ করে দিয়েছে। ধনী দেশগুলো হিমশিম খেয়েছে করোনা মোকাবিলা করতে। আমরাও মোকাবিলা করেছি এবং বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সাফল্যও পেয়েছি। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে যখন আমরা সামনের দিকে এগোনের পথ খুঁজছি; তখনই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরাশক্তিদের একগুঁয়েমিতে সারাবিশ্ব আরো টালমাটাল হয়ে গেল। করোনাকালের চেয়েও যুদ্ধ-পরিস্থিতি আমাদেরকে গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই এই যুদ্ধকে করোনার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়।
সারা বিশ্বে অর্থনীতিতে টান পড়েছে। আমাদের মতো দেশে তো বটেই। এই অর্থনৈতিক মন্দার ফলেই সক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না কাঁচামালের অভাবে। উন্নয়নের সবকিছুর সঙ্গেই জ্বালানির সম্পর্ক। বৈশ্বিক সঙ্কটে জ্বালানির টান পড়েছে। ফলে এর প্রভাব পড়ছে সবখানেই। সবকিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে এ সঙ্কট প্রলম্বিত হতে পারে। তবে রাষ্ট্রযন্ত্র ও আপামর খেটে খাওয়া সর্বস্তরের মানুষের চেষ্টার যে কমতি আছে, তাও নয়। সকলে সর্বশক্তি ব্যয় করছে পরিস্থিতি উত্তরণে। সঙ্কট উত্তরণে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশকিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। এজন্য সবার আগে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটের কথা নানা ফোরামে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু খাদ্য উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে এখন থেকে পরিকল্পনামত এগোতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনও জমি চাষ না করে ফেলে রাখা যাবে না। আবাদ করতে হবে। এটা করতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়ক হবে। সরকার করোনার মত বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সফল হয়েছে। বর্তমান যুদ্ধজনিত সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। একইভাবে সরকার ২০২৩ সালের সম্ভাব্য সংকটজনক পরিস্থিতিও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
২০২৩ সালের শুরুতে ভালো খবর পাচ্ছি। ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে গার্মেন্টস রপ্তানির দ্বিতীয় স্থান পূর্ণদখল করা গেছে। এ মাসে প্রবাসী আয় বেড়েছে। রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। ২০২৩ সালে আমরা হারব না। বাঙালি হারতে জানে না। কোনো না কোনো উপায় ঠিকই বের হয়ে যাবে যে বাংলাদেশ ভালো করার প্রকৃত উপলক্ষ ও পটভূমি পেয়ে যাবে।
যেসব কারণে আমারা ২০২৩ নিয়ে আশাবাদী হতে পারি, তার একটা তালিকা প্রণয়ন করা যাক। ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়। ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে। ফলে সরকারকে জনবান্ধব কর্মসূচি দিতেই হবে। কাজেই জনগণের জন্য ২০২৩ হবে তুলনামূলকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যময়।
২০২৩ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট (ওডিআই) হবে ভারতে। স¤প্রতি আমরা ওডিআইতে সিরিজ জিতেছি ভারতের বিরুদ্ধে। এক দিনের ম্যাচে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। ২০২৩ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খুব ভালো ফল আমরা আশা করতেই পারি।
এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ২০২৩ সালে থেমে যেতে পারে। ক্যানসারের টিকা আবিষ্কৃত হতে পারে। আণবিক ফিউশন করে সবুজ জ্বালানির পথ উন্মোচিত হয়েছে। বিনিয়োগ আসছে এই ক্ষেত্রে। বিকল্প সবুজ জ্বালানি এসে গেলে পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যাবে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শক্তি। তারা এ দেশকে ফল, মাছ, দুধ, সবজি উৎপাদনে চ্যাম্পিয়ন করে রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের শক্তিতেই ২০২৩ সালের মন্দা ও মঙ্গা বাংলাদেশকে কবজা করতে পারবে না।
নতুন বছরে নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছে দেশের আপামর সাধারণ মানুষ। মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখছে শান্তি, স্বস্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির। দেশবাসী প্রত্যাশা করে সন্ত্রাসবাদমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ। বিনাশ হবে অগণতান্ত্রিক অপশক্তি, ধর্মীয় উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও অপরাজনীতি। ব্যক্তি ও সমাজীবনের মত রাষ্ট্রীয় জীবনেও স¤প্রীতি ও সমঝোতার সংস্কৃতির চর্চায় রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে অগ্রসর হবে। নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কাজে সকলে সম্মিলিতভাবে আত্মনিয়োগ করবে। মানবিক মূল্যবোধ, মুক্তচিন্তা, জীবনের নিরাপত্তা, সহনীয় দ্রব্যমূল্য, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আরও এগিয়ে নিতে সবাই একযোগে কাজ করবে। দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে জীবনযাপনের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে। জাতির জীবনের সর্বক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রয়াসের সূচনা হোক। শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য আর দেশমাতৃকার প্রতি অকৃত্রিম ও অগাধ ভালবাসায় নতুন এক বাংলাদেশ হোক নতুন বছরের অঙ্গীকার।
বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবনের স্বপ্ন। তিনি চেয়েছেন ‘সোনার বাংলা’ আর ‘সোনার মানুষ’। বাঙালি শুধু বাঙালি হয়ে থাকবে না, ‘মানুষ’ হবে- এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এবং বিশ্বাস। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণের পথে বাংলাদেশ ২০২৩ সালে আরও এগিয়ে যাবে- ইংরেজি বর্ষবরণের প্রাক্কালে এমনটাই প্রত্যাশা বাংলার আপামর জনসাধারণের।