নতুন জটিলতায় ওয়াসার পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প

41

সবুর শুভ

চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ (পয়ঃনিষ্কাশন) প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা হচ্ছে প্রায় ৬০ বছর ধরে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু আচমকা আদালতের নিষেধাজ্ঞা সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের এ জায়গা ৬২/৬৩ সালে অধিগ্রহণ হয়েছে কি হয়নি, তা নির্ধারণ নিয়ে চলেছে লম্বা আইনি লড়াই। ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকার বড় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাঝখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে আইনি জটিলতা।
স্থানীয়দের আবেদনের (মামলা দায়ের) প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ নুসরাত জাহান প্রকল্পের উপর অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ওয়াসাকে থামিয়েছে আপাতত। এরপর এবার তারা আদালত অবমাননার বিষয়ে প্রতিকার চাইতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। আদালত অবমাননার প্রতিকার চেয়ে করা আবেদনে বিবাদী করা হচ্ছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এমনটি জানিয়ে ‘অধিগ্রহণ না হওয়া হালিশহরের কৃষিজমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’র সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ এনামুল হক মুনিরী বলেন, আগামী ৩/৪ দিনের মধ্যেই আদালত অবমাননার বিষয়ে রিট করা হবে হাইকোর্টে। বারবার আদালতের আদেশকে কেন অবজ্ঞা করা হল, তা আদালতের নজরে আনব।
এদিকে ইতোমধ্যেই আইনি জটিলতায় পড়া ওয়াসার বিরুদ্ধে যদি আবার আদালত অবমাননার মামলা হয় তাহলে পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প বাস্তবায়নে আইনি লড়াই আরও দীর্ঘ হবে বলে জনান সংশ্লিষ্টরা। ফলে আইনি চক্করে পড়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে মুনিরী বলেন, আমরাও প্রকল্প বাস্তবায়ন চাই। কিন্তু প্রকল্পের নামে মানুষের ভূমি কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়া কেড়ে নেয়া রীতিমত অসাংবিধানিক, অনৈতিক ও বেআইনি।
এদিকে গত ৪ এপ্রিল উল্লেখিত প্রকল্পের উপর দেয়া যুগ্ম জেলা জজের অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আফরোজা আকতার জানান, চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ হাজির হয়ে এ বিষয়ে তাদের জবাব না দেওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের কাজে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। সেই পর্যন্ত কোন কাজ করতে পারবে না ওয়াসা। দুই মাস আগে নিষেধাজ্ঞার এ আবেদন করা হয়েছিল বলে জানান আইনজীবী আফরোজা।
আদালত প্রথমে নিয়ম অনুযায়ী ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে ১০ দিনের সময় দিয়ে শো’কজ করেন গত ৭ মার্চ। কিন্তু ওয়াসার তরফে এ সংক্রান্তে কোন জবাব দাখিল করা হয়নি বলে জানালেন মামলার বাদীপক্ষ।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাকসুদ আলম জানান, শো’কজের জবাব দেয়ার বিষয়টি অন্য বিভাগ দেখে, তাই বিস্তারিত বলতে পারছি না।
এদিকে ওয়াসায় যে জায়গায় পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, তার মালিকানা দাবি করা মানুষের সংখ্যা ৭/৮ হাজার বলে আদালতে দাখিল করা মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
তথ্যমতে, মধ্য হালিশহরের চৌচালা এলাকায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও স্যুয়ারেজ প্রকল্পের জন্য ১৯৬২-৬৩ সালে ১৬৩ দশমিক ৮৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল ওয়াসা। ১৯৭০ সালের ৫ আগস্ট সেখান থেকে ১৩৪ দশমিক ১৪৫ একর জায়গা অবমুক্ত করা হয়। এ নিয়ে নোটিশও জারি করা হয় জানিয়ে
এনামুল হক মুনিরী বলেন, আরএস ও পিএস জরিপমূলে এ জায়গা আমাদের। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুকুলে বিএস নামজারি হওয়ার পর আমরা এ নিয়ে আইনি লড়াই করে একটি জায়গায় এসে থেমেছি।
দীর্ঘদিনেও প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় অধিগ্রহণ করা জমি ফেরত চেয়ে ২০০১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন স্থানীয়রা। রিট নং-৪১২৭/১। রিটে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম ওয়াসাকে বিবাদী করা হয়। ২০১৪ সালে হাইকোর্ট চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু জেলা প্রশাসন কিছু করেনি। এরপর ওয়াসার পক্ষ থেকে হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে হাইকোর্টের উল্লেখিত রিট আদেশকেই বহাল রাখা হয়। লিভ টু আপিলের ফলাফল স্থানীয়দের পক্ষে যায়।
এনামুল হক মুনিরী জানান, অধিগ্রহণের বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না করেই স্যুয়ারেজ প্রকল্প শুরু করায় আমরা মামলা করি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হলে সেখান থেকেও একটি নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ১৩৪ দশমিক ১৪৫ একর জায়গার উপর আমাদের দাবিনামা। আমরা জমি ফেরত চাই। আর যদি সরকারি প্রকল্পের প্রয়োজনে জমি প্রয়োজন হয়, ভূমি মালিকরা তা দেবে। সেজন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তথ্যমতে, ২০১৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম নগরীর ড্রেনেজ ও স্যানিটেশন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। মহাপরিকল্পনায় পুরো নগরীকে ছয়টি জোনে ভাগ করে ছয়টি পয়ঃশোধনাগার এবং দুটি ফিকাল স্লাজ শোধনাগার স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার তায়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ পায়। জানুয়ারি মাসে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে ওয়াসা। বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন প্রকল্পের (প্রথম পর্যায়) ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকার দিচ্ছে ৩ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা এবং ওয়াসা ৫০ কোটি টাকা দিচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত হলে প্রতিদিন ১০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য এবং ৩০০ ঘনমিটার ফিকাল স্লাজ পরিশোধন সম্ভব হবে; যা নগরীর মোট পয়ঃবর্জ্যের ২০ শতাংশ এবং ফিকাল স্লাজের ৪১ শতাংশ। পরে আরও পাঁচটি ধাপে পুরো নগরী পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় আসবে।
একই কথা উল্লেখ করে প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, বাদীপক্ষ অনেক কিছুই গোপন করেছে। আমরা আসল তথ্যটা আদালতে তুলে ধরব। জায়গাটা চট্টগ্রাম ওয়াসার। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে নিষ্পত্তি হয়েছিল। সেই নিষ্পত্তির কারণেই তো দুই বছর আগে সীমানা দেয়াল করলাম। এখন কাজ শুরুর পর তারা আদালতে গেলেন। নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত আদালতের আদেশ এখনও আমরা পাইনি। পেলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।
আদালত অবমাননার বিষয়ে এনামুল হক মুনিরী বলেন, এ জায়গাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট- কোন আদালতের আদেশ মানা হয়নি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তরফে। এ কারণে আমরা হাইকোর্টে আদালত অবমাননার প্রতিকার চেয়ে হাজির হবো ৩/৪ দিনের মধ্যেই। এ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।