নতুন কারিকুলাম এবং শিক্ষক সমাজ

51

সুলতানা কাজী

শিক্ষকতা কোনো চাকুরী বা ব্যবসা নয়। এটা এমন এক দায়িত্ব, ছোট্ট মানব শিশুকে সত্যিকারের মানুষরূপে বিকশিত করার সুকঠিন এবং সুশৃঙ্খল দায় যার মাথায় সবসময় খেলা করে। শিক্ষকদের বলা হয়, জাতি গঠনের কারিগর। বার্ট্রান্ড রাসেল শিক্ষকদের সভ্যতার অভিভাবক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। শিক্ষক হবেন নৈতিকতা, সততা, সহমবোধ সম্পন্ন, সময়নিষ্ঠাবান, প্রাণময় ইত্যাদি গুণে ভরা। চীনের প্রাচীন নেতা কনফুসিয়াস বলেছেন, শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি হবেন একজন আদর্শ শাসক। যার দ্বার থাকবে উন্মুক্ত। শিক্ষক হবেন সভ্যতার অভিভাবক।
তিন অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ ‘শিক্ষক’। শি-শিষ্টাচার, ক্ষ-ক্ষমাশীল, ক-কর্তব্যপরায়ণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষক সম্পর্কে বলেছেন, কৌতুহল জাগানো ও কৌতুহল নিবৃত্ত করা শিক্ষকের কাজ। শিক্ষকগণ জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও মূল্যবোধ জাগরণে জাতিকে জাগিয়ে তোলেন। সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট না করে দেশ ও জাতিকে উন্নত করে আলোকিত মানুষ, আলোকিত সমাজ গঠনে মশগুল থেকে স্বপ্ন পূরণের সারথি হন শিক্ষকগণ। শিক্ষকতা মহৎ পেশা। শিক্ষক মানে আলোকবর্তিকা। মোমবাতির মতো জ্বলতে জ্বলতে শেষ অবধি জ্বলায়’ই শিক্ষকের ব্রত। শিক্ষকদের কদর এবং সম্মান দেখানো রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শিক্ষকদের অকদর্য করা মানেই জাতির প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো।
শিক্ষকদের সম্মানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন, যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারেনা। আমি সাধারণ একজন বাংলা শিক্ষক। নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা -২০২১ এবং নতুন শিক্ষাক্রম বিস্তরণ -২০২২ এর আমি একজন মাস্টার ট্রেইনার। প্রথমেই নতুন শিক্ষাক্রমকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। স্যাল্যুট প্রদর্শন করছি সেইসব শিক্ষাবিদগণের প্রতি, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার কারণে, আজ আমরা ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামে পাঠ দান করছি। এতো সুন্দর একটা কারিকুলামে আমরা কেনো পড়তে পারিনি, বলে আক্ষেপ লাগছে খুব! পুরোনো পাঠদান পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ ইরেজ বা ডিলিট করে নতুন পদ্ধতি আসলেই অ্যামেজিং ঠেকছে আমার কাছে! ক্লাসের প্রতিটা শিক্ষার্থী নতুন পদ্ধতিতে নিজেকে নতুনভাবে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করছে যেনো! দেশপ্রেম, শিষ্টাচার, মানবিকতা এবং বৈশ্বিক নাগরিক হওয়ার অভূতপূর্ব নিদর্শন এ কারিকুলামে। কোনো ভেদাভেদহীন একীভূত শিক্ষা। পূর্ব অভিজ্ঞতাকে পারস্পরিক আলোচনায় রেখে নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে যোগ্য করার নান্দনিক এ পদ্ধতি, সত্যিই যুগোপযোগী।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশের সাথে সাথে এটাও বলা দরকার যে, শিক্ষার্থী মূল্যায়নে কিছুটা পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা হলে আরো বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করছি এ শিক্ষাক্রম। আজকের শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা স্বপ্ন দেখবে পুরো বিশ্বকে জয় করার। তারা স্বপ্ন অন্যদেরও দেখাতে সক্ষম হবে এ শিক্ষাক্রম থেকে। শিক্ষাক্রমের একনিষ্ঠ সারথি হয়ে আরেকটা কথা না বললেই নয়, তা হলো….
শিক্ষক নিজে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। তার মানসিক প্রশান্তি বিশেষভাবে এ শিক্ষাক্রমে প্রয়োজন। যেখানে প্রতিটা ক্লাসকে প্রুফফুল করতে হাসি হাসি মুখ এবং করতালি নিত্যসঙ্গী করার কথা, সেখানে শিক্ষকগণের মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা জরুরি। প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনে রাখা দরকার, কি করলে বা কোন উপায়ে শিক্ষকগণ শারীরিক এবং মানসিক প্রশান্তি পাবেন। সদাচার এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ আনয়নে প্রতিষ্ঠানের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন এনে নান্দনিক এ কারিকুলামকে ধারণ এবং এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমাদের। হিংসা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, লোভকে বিসর্জন দিয়ে জাতিকে উন্নত করার মানসিকতা রোপিত হোক সবার মনে। জয় হোক শিক্ষক সমাজের।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক