নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ইতিকথা

102

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি বিদ্রোহী কবি নামে খ্যাতি অর্জন করেন। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৩২৮ বঙ্গাব্দে ও পরবর্তীতে অন্তত চারটি সাহিত্য সাময়িকীতে। “বিদ্রোহী” কবিতাটি ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোন রাতে রচিত হয়েছিলো বলে জানা যায়। “বিদ্রোহী” কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকায় ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ শুক্রবার, আর ইংরেজি ৬ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ। মূলত “বিদ্রোহী” কবিতা প্রকাশিত হবার পর থেকেই নজরুল বিদ্রোহী কবি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্ব সাহিত্যে “বিদ্রোহী” একটি স্বনামধন্য কবিতা। ১৯২০ সালে ৪৯ নং বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে গেলে নজরুল প্রথমে তার সতীর্থ বাল্যবন্ধু কথাসাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাসায় ওঠেন। সেখানে কয়েক দিন থেকে আরেকটি বাসস্থান পরিবর্তন করেন। পরবর্তীতে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে ওঠেন। সেখানেই তার বন্ধু মুজফফর আহমদ থাকতেন। তার সঙ্গে নজরুল বসবাস করেছেন আরো কয়েকটি বাসায়। শেষে ৩/৪ সি তালতলা লেনে উঠে আসেন। মুজফফর আহমদের দেয়া তথ্যে জানা যায়, “বিদ্রোহী কবিতা” কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে রচিত হয়েছিল। তখন ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িটি ছিল চারখানা ঘরের একটি পুরো দোতলা বাড়ী। তার দোতলায় দু”খানা ঘর ও নিচের তলায় দুটি ঘর ছিল। তৎকালীন এই পুরো বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন ত্রিপুরা জেলার পশ্চিম গাঁর নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর নাতিরা। মুজফফর আহমদ তাঁর স্মৃতি কথায় জানিয়েছে, “বাড়ির নিচতলার দক্ষিণ পূর্ব কোনের ঘরটি নজরুল ও তিনি ভাড়া নিয়েছিলেন। এই ঘরে বসেই নজরুল তাঁর বিদ্রোহী কবিতাটি লিখেছিলেন। সে কবিতাটি লিখেছিলেন রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময় তা আমি জানিনে। রাত ১০টার পর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে বসেছি এমন সময় নজরুল বলল সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন পড়ে শোনালো। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আমি প্রথম শ্রোতা। নিজের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে কোনদিন কোন বিষয়ে আামি উচ্ছ¡সিত হতে পারি না। যে লোক প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য তার সামনা-সামনি তাকে প্রশংসা করাও আমাকে দিয়ে হয়ে উঠে না। আমার এই স্বভাবের জন্য আমি সর্বদাই পীড়া বোধ করি। আমার স্বভাবের দোষে আমি তাকে এতোটুকু বাহবা দিতে পারলাম না। তাই বিদ্রোহী কবিতা টা পড়ে আমি কোনো উচ্ছ¡সিত হতে পারি নাই। নজরুল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি সর্বপ্রথম আমাকেই পড়ে শোনালো। অথচ আমার স্বভাবের দোষে আমি তার প্রশংসা করতে পারলাম না। আমার স্বভাবটা যদিও নজরুলের অজানা ছিল না, তবু সে মনে মনে আমার উপর মনোক্ষুন্ন হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নাই।” কবিতাটির রচনা প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদ আরো বলেছেন, “আমার মনে হয় শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিলেন। তা না হলে এতো সকালে সে আমাকে কবিতা টা পড়ে শোনাতে পারতো না। তবে তার ঘুম সাধারণত দেরিতেই ভাঙ্গতো। আমার মতো তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গতো না। নজরুল কিংবা আমার ফাউন্টেনপেন ছিল না। সম্ভবত কবিতাটি সে সময়ে প্রথমে পেন্সিলে লেখা হয়েছিল।” “বিদ্রোহী” কবিতা কোন পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়েছিল তা নিয়ে বির্তক আছে। “বিদ্রোহী” কবিতাটি প্রথম ছাপা হওয়া প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদ তাঁর গ্রন্থে বলেন, সামান্য কিছু বেলা হতে “মোসলেম ভারত” পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হক আমাদের বাড়িতে এসে উঠলেন, নজরুল খুব উচ্ছ¡সিতভাবে তাঁকে এ কবিতাটি পড়ে শোনালেন। কবিতাটি শোনবার পরে তিনি খুব হইচই শুরু করে দিলেন এবং নজরুলকে তাৎক্ষনিক বললেন, এখনই কপি করে দিন, কবিতাটি আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো। পরম ধর্য্যের সাথে কবিতাটি কপি করে নজরুল তা আফজাল সাহেবের হাতে তুলে দিলেন এবং তিনি তাৎক্ষণাৎ কপিটি নিয়ে চলে গেলেন। “মোসলেম ভারত” পত্রিকায় প্রকাশের জন্য নজরুল “বিদ্রোহী” কবিতা সর্ব প্রথম সম্পাদক আফজালুল হককে দিয়েছিলেন। কিন্তু “মোসলেম ভারতের” কথিত সংখ্যাটি বের হতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি (২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে শুক্রবার “বিদ্রোহী” বিজলীতেই সর্ব প্রথম ছাপা হয়। প্রবল বৃষ্টি হওয়া সত্তের্¡ও সে দিন কাগজের চাহিদা এত বেশি হয়েছিল যে সাপ্তাহিক “বিজলী” সপ্তাহে দু’বার ছাপা হয়েছিল। পরবর্তীতে মোসলেম ভারত ও প্রবাসী পত্রিকায়ও “বিদ্রোহী” কবিতটি ছাপা হয়। স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়লেন। “বিদ্রোহী” প্রকাশিত হওয়ার পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দেখা হয়। শ্রী অবিনাশ ভট্টাচার্য্য এ প্রসঙ্গে বলেন, “পরের দিন সকালে এসে কবি চারখানা “বিজলী” নিয়ে গেলো, বললে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। বিকেলে এসে রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে যাওয়ার ঘটনাটা স্ববিস্তারে বর্ণনা করল। তাঁর বাড়ীতে গিয়ে “গুরুদেব গুরুদেব বলে চেচাঁতে থাকে। ওপর থেকে রবীন্দ্রনাথ বললেন “কি কাজী অমন ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছো কেন? কী হয়েছে? আপনাকে হত্যা করবো, গুরুদেব আপনাকে হত্যা করবো। হত্যা করবে? হত্যা করবে? কি ওপরে এসে বলো, হ্যাঁ, সত্যিই বলছি, আপনাকে হত্যা করবো, বসুন, শুনুন। কাজী দাড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি সহকারে “বিজলী” হাতে নিয়ে উচ্চস্বরে “বিদ্রোহী” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়ে দিলো। তিনি স্তদ্ধ বিস্ময়ে কাজীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে কাজীকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন। হ্যাঁ কাজী তুমি আমায় সত্যি হত্যা করবে”।
নজরুল মূলত ছিলেন আত্ম ভোলা ও পাগলাটে ধরণের মানুষ। প্রতিভা তাঁর যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু সাধনা অধ্যবসায় ছিল না তাঁর। এত বিখ্যাত মহৎ তাঁর বিদ্রোহী কবিতাটি তাও তিনি চিরকুট টুকরো কাগজে লিখেছিলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর এই জনপ্রিয় বিদ্রোহী কবিতাটি সেকালের “সাপ্তাহিক বিজলী” পত্রিকায় পর পর দু’বার ছাপা হয়েছিল। তিনি সে সময় এই বিদ্রোহী কবিতাটি লিখে সারা ভারত বর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তৎকালীন তাঁরই খ্যাতির বিড়ম্বনাও তাঁকে সে সময় যথেষ্ঠ দিতে হয়েছিল। তাঁরই এই জনপ্রিয়তার জন্য প্রথম শত্রæ হয়ে দাড়িয়েছিলেন সেকালের প্রখ্যাত “শনিবারের চিঠি” পত্রিকার সম্পাদক “সজনীকান্ত দাস”। স্বয়ং নিজে তিনি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ব্যাঙ্গাত্মক অশ্লীল প্যারোডি তৈরি করেন এবং ১৯২৪ সালে “শনিবারের চিঠি” পত্রিকাতে তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এখানে তাঁর কিছুটা অংশ হুবহু তুলে ধরা হলো-
আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই,
আমি বুক দিয়া হাঁটি, ইঁদুর-ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।
আমি ভীম ভুজঙ্গে ফণিনী দলিত ফণা,
আমি ছোবল মারিলে নরের আয়ু মিনিটে যায় গনা।
আমি নাগশিশ, আমি ফণিমনসার জঙ্গলে বাসা বাঁধি,
আমি বে-অব বিস্কে, সাইক্লোন আমি, মরু সাহারার আঁধি।
সে আমলে কলকাতায় পুজা সংখ্যায় “আমি বীর” নামের নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আরেকটি প্যারডি ছাঁপা হয়। এই কবিতাটি যোগানন্দ দাশ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, সজনী কান্ত দাশের যৌথ প্রয়াসে কবিতাটিতে তাঁরা ছদ্ম নাম ব্যবহার করে। কবিতাটি হলো-
আমি বীর
আমি দুর্জয়, দূর্ধর্ষ, রুদ্র দীপ্ত উচ্চ শির,
আমি বীর!
দু’চোখে আমার দাবানল জ্বলে জল জল জল
আমি বীর! আমি বীর!!
আমি ভাঙ্গি বেঞ্চি ও চেয়ার,
আমি করিনা কারো কেয়ার,
হৃদি নিয়ে আমি ছিনিমিনি খেলি, লাখ লাখ তরুনীর,
আমি বীর!
একসময় কবি নজরুল ইসলামের খুব আপন জন ছিলেন মোহিত লাল মজুমদার ও সজনীকান্ত দাশ। তাঁরা “বিদ্রোহী” প্যারোডি ব্যঙ্গ এবং নানা বাজে লেখা লিখেন কবির বিরুদ্ধে। নজরুল অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন সে সময়।
সে সময় নজরুলের যারা অন্ধ সমালোচক তারাও কবিতাটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। কবিতাটি লেখা হয়েছিলো যখন দেশের তরুণ সমাজ উদ্বেলিত হয়েছিল দেশ মুক্তির সংগ্রামে। পরাধীনতার শেকল ভাঙ্গার মন্ত্রে। নজরুলের সঙ্গে বাংলার আরেক বিখ্যাত কবি মোহিত লালের বন্ধুত্ব ছিলো প্রগাঢ়। নজরুলের গৃহে মোহিত লাল নিয়মিত আসতেন। আসরে বসে একত্রে কবিতা পড়তেন নিয়মিত কিন্তু বিদ্রোহী কবিতা রচনার পর নজরুল ও মোহিত লালের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে এবং দু’জনের সর্ম্পক তিক্ত হয়ে ওঠে। মোহিত লাল দাবি করেন “মানষীর” ১৩২১ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় তাঁর রচিত “আমি” গদ্য রচনার ভাব চুরি করে নজরুল তাঁর “বি্েরদ্রাহী” কবিতাটি রচনা করেছেন। মোহিত লাল তাঁর রচনাটি নজরুলকে পড়িয়েও শুনিয়ে ছিলেন বলে মুজফফর আহমদ পরবর্তীতে জানিয়েছিলেন, এটি নজরুলের “বিদ্রোহী” রচনার এক বছর আগের ঘটনা। “আমি” ও “বিদ্রোহী” পাশাপাশি পড়লে কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায় বটে কিন্তু “আমি” একটি দার্শনিক গদ্য রচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর “বিদ্রোহী” উন্মাদনা পূর্ণ এক অনবদ্য রচনা যার রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের দিকটি খুবই উল্লেখযোগ্য। মোহিত লালের গদ্য রচনায় এসব নেই। কাল পেরিয়ে গেলে ও “বিদ্রোহী” এক অনবদ্য রচনা। নজরুলের “বিদ্রোহী” ভারতীয় রাজনীতির তুঙ্গ মুহুর্তেই প্রকাশিত হয়েছিল এবং তরুণ মনকে অপূর্ব প্রেরণায় অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৪টি ছোট-বড় স্তবকে ও ১৪১ টি পঙ্টিতে সম্পূর্ণ বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত। এতে নজরুল “আমি” সর্বনামের ব্যবহার করেছেন মোট ১৪৫ বার। “বিদ্রোহী” কবিতার ৯৯ বছর পূর্ণ হতে চলেছে আর মাত্র ১ বছর পর কবিতাটি স্পর্শ করবে শত বর্ষের গৌরব। পরাধীন দেশের আবর্তে নজরুল ছিলেন প্রচন্ড রকমের স্বাধীনতা প্রেমিক “বিদ্রোহী” কবিতার প্রথম ও প্রধান বিদ্রোহ ছিল রাজনৈতিক, পরাধীনতা, সামাজিক অন্যায়, অর্থনৈতিক শোষন ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন মূলত: মানবতার কবি দুর্বার আত্মবোধে নজরুল ছিলেন অটল। অবিচল আত্মবিশ্বাসের প্রতীক “বিদ্রোহী” কবিতা রচনা করার পর কবি মাত্র বিশ বছর সাহিত্য চর্চা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে ১০ জুলাই নজরুল সম্পূর্ণভাবে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এরপর তার সাহিত্য সাধনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।