নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে এবার মনোযোগী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়

81

জলাবদ্ধতার অভিশাপ চট্টগ্রাম শহরের জন্য নতুন নয়। প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধতা হবে, এটা নিয়ে এক প্রকার সংশয়হীন নগরবাসী। তবে কতটুকু পানি হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা ও নগরবাসীর মধ্যে রয়েছে ভিন্নমত।
নগরীর অসহনীয় এ জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার ৮০৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিনটি সেবা সংস্থা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর মধ্যে সিডিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুইটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী।
প্রকল্পগুলোর কোনটি ৪ বছর ধরে, কোনটি ৭ বছর ধরে, কোন প্রকল্পের কাজ চলছে ২ বছরের বেশি সময় ধরে। কিন্তু ফি বছর জলাবদ্ধতার তীব্রতা কমে না। বরং বেড়ে যায়। এবার মাত্র ৪৪ মিলিমিটারের বৃষ্টিতে বাজেভাবে তলিয়ে যায় নগরীর অধিকাংশ এলাকা। এতে নড়েচড়ে বসে সরকারি সংস্থাগুলো।
নগরীতে পানির কারণে জনদুর্ভোগের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এতে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মনোযোগী হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এতো টাকা খরচ করার পরও কেন নগরজুড়ে জলবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে, তার কারণ জানতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সব সেবাসংস্থাকে নিয়ে এক টেবিলে বসতে চায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
আগামী বুধবার (১৬ জুন) জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিয়ে ভার্চ্যুয়ালি এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেবেন।
এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৩ মুহাম্মদ শাহীন ইমরান স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম নগরের প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবরা অংশ নেবেন। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রকল্প পরিচালকদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়।’
এবার সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার বিষয়টি বেশ আলোচিত হওয়ায় সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রæত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করার অংশ হিসেবেই এ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চট্টগ্রামে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সংশ্লিষ্টরা সিডিএ’র কনফারেন্স হল থেকে ভার্চ্যুয়াল সভায় যোগদানের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস।
সংস্থাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, চার প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ১০ হাজার ৮০৩ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা। চারটি প্রকল্পই চলমান। প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। তবুও ডুবছে নগর।
‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, স¤প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সিডিএ ২০১৭ সালের আগস্টে এটি একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী-সিডিএ সমঝোতা চুক্তি হয়। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। করোনাসহ নানা কারণে ২০২০ সালের জুন মাসে কাজ শেষ হয়নি। পরে দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। প্রকল্পে ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। তবে তৃতীয় দফায় দুইবছর মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করা হয়।
এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির কাজ ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। তবে জলকপাট নেদারল্যান্ড ও পাম্প মেশিন ইংল্যান্ড থেকে আনা হচ্ছে। করোনার কারণে সেগুলো যথা সময়ে আসেনি। এ জায়গায় আমরা কিছুটা আটকে আছি।
এদিকে দুই হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এটাও জলাবদ্ধতা নিরসন নির্ভর। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল এটি একনেকে অনুমোদন পায়। কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর। প্রকল্পের আওতায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ৮ দশমিক ৫৫ কিলোমিটার সড়কসহ বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাতটি স্লুইসগেট নির্মাণকাজের ৮০ শতাংশ ও তিনটির ৩৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি দুটির কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে। চলতি মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। ইতোমধ্যে ব্যয় হয়েছে ৬৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী রাজীব দাশ জানান, প্রকল্পটি কাজ ৫০ শতাংশ শেষ। স্লুইসগেটগুলোর মধ্যে পাঁচটি কাজ প্রায় শেষ। করোনা পরিস্থিতির কারণে কিছু কাজ ধীর গতিতে হয়েছে। অন্যথায় আমরা প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শেষ করার পথে আরও এগিয়ে যেতে পারতাম।
অন্যদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৪ সালের ২৪ জুন ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ ৪ হাজার টাকায় বারৈইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি নতুন খাল খনন প্রকল্প একনেক অনুমোদন দেয়। অনুমোদনের পর সাত বছর পার হলেও শুরুই হয়নি খাল খনন কাজ। এরই মধ্যে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে পাঁচগুণ। ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা বেড়েছে বহুগুন। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি খাল খননের দাপ্তরিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন ছাড়া ফটোসেশন করে কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু ওই শুরুটা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। শুরু হয়নি ভৌত কাজ, কাটা হয়নি কোন মাটি। ২০১৪ সালের ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ ৪ হাজার টাকার প্রকল্পটি সাত বছর পর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে এখন ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ৯১১ কোটি টাকা। এ অবস্থায় নামেই আছে প্রকল্পটি। কাজে নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক এক হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারিতে একনেকে অনুমোদন পায়। ২০২২ সালের জুনের প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে কাজটি এখনও শুরু হয়নি। প্রকল্পের আওতায় ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন ও কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মাণ হবে ১৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সমন্বিত কাজের উপর গুরুত্বারোপ ও কাজের অগ্রগতি সর্ম্পকে ১৬ জুনের সভায় আলোচনা হবে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখিত চারটি প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করা মানে চট্টগ্রামের উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া। এটাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।