নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের ২৫০ সদস্য চিহ্নিত

62

নগরীতে ভয়াবহ বিস্তার লাভ করেছে ‘কিশোর গ্যাং’ কালচার। এলাকাভিত্তিক গ্রæপ করে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। তাদের হাতে দেড় বছরে খুন হয়েছে ৮ জন। পুলিশ এধরনের ২৫০ জন কিশোরকে চিহ্নিত করে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে। ইতিমধ্যে অন্তত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্রুপভিত্তিক গ্যাং কালচার সক্রিয় রয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় একাধিক গ্রুপও রয়েছে। মাদক ব্যবসা, ছিনতাই-ইভটিজিং তাদের রুটিন কাজ। পান থেকে চুন খসলেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়। আর খুন-খারাবির ঘটনাতো ঘটাচ্ছে অহরহ।
র‌্যাব-পুলিশ বলছে, নানা কারণে কিশোর বয়সি ছেলেরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। খুন, ছিনতাইসহ এহেন অপরাধ নেই যা তারা করছে না।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কিশোর গ্যাংয়ে জড়িতদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর। ২০ বছর বয়সি থাকলেও তা সংখ্যায় কম। এদের অনেকেই স্কুলের গন্ডিও পার হতে পারেনি। পশ্চিমা কালচারের আদলে তাদের চলাফেরা। তাদের অনেকের কাছে রয়েছে ধ্রুতগতির মোটরসাইকেল। শব্দ করে তারা মোটরসাইকেল চালায়। রাতে বা দিনের যেকোনো সময় একে অপরের সাথে মিলিত হয় তারা। মূলত ফেসবুকে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ হয়।
স্কুলেও রয়েছে গ্যাং। সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে গ্যাং তৈরি করেছে কিশোররা। স্কুল ছুটির আগে-পরে মিলিত হয় তারা। অনেক সময় স্কুল পালিয়েও গোপন বৈঠক করে। মাদকও সেবন করে তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীতে গত দেড় বছরে তাদের হাতে খুন হয়েছে ৮ জন।
পুলিশ বলছে, তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটি, ফেসবুক-মুঠোফোন, প্রেম, চুরি-ছিনতাইসহ নানা ইস্যুতে সামান্য মতানৈক্য হলেই এদের মাথায় খুন চেপে বসে। তবে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে।
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসপারকে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে হত্যার ঘটনার পর নগর দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর অপরাধীদের নিয়ে নড়েচড়ে বসে সিএমপি। চলতি বছরের ৬ এপ্রিল নগরের গোলপাহাড় এলাকায় এক স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার জেরে কিশোরদের দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ দ্ব›েদ্বর জেরে গোলপাহাড় এলাকার যুবলীগ কর্মী এমএইচ লোকমান রনি নিহত হন স্থানীয় সন্ত্রাসী সাইফুল ইসলামের গুলিতে। এর দু’দিন পর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় সাইফুল।
১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিন ইয়াবা সেবনের টাকা না পেয়ে বাবা রঞ্জন বড়ুয়াকে ছুরিকাঘাতে খুন করে তার ছেলে রবিন বড়ুয়া। নগরীর কাজির দেউড়ির ব্যাটারি গলিতে এ ঘটনা ঘটে। ১০ মে পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর পিলখানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ছুরিকাঘাতে খুন হন মোস্তাক আহমেদ (৩৫)। ছেলের সঙ্গে বখাটে কিশোরদের ঝগড়া মেটাতে গেলে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ১৪ মে নগরের ডবলমুরিং থানার হাজিপাড়ায় রিকশাচালক রাজু আহমেদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দেয় ১০-১২ জনের কিশোর। ১৮ জুলাই রাতে পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় কিশোর অপরাধীদের নিজেদের মধ্যে কোন্দলের জেরে খুন হয় মোবারক হোসেন (২০) নামের এক কিশোর।
কিশোর অপরাধের সর্বশেষ বলী জাকির হোসেন সানি (১৮)। ২৬ আগস্ট দুপুরে নগরের খুলশী থানার জাকির হোসেন সড়কে ওমরগণি এমইএস কলেজের ফটকের অদূরে ইক্যুইটি ভবনের সামনে ছুরিকাঘাতে খুন হয় সানি।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোস্তাইন হোসেন বলেন,কিশোর অপরাধ খুবই মারাত্মক। তারাই একদিন বড় সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়। তাদের এখনই রুখে দিতে হবে। তিনি বলেন, কিশোর অপরাধ রুখতে সকল পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ। ইতিমধ্যে অপরাধে জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কঠোরভাবে তাদের দমন করা হবে।
পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোনো এলাকায় একজন কিশোর অপরাধীও যাতে থাকতে না পারে সেজন্য পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
সিএমপি সূত্রে জানা যায়, পুলিশ অপরাধে জড়িত ২৫০ জন কিশোরকে চিহ্নিত করেছে। থানাভিত্তিক অনুসন্ধান চালিয়ে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কিশোরের যাবতীয় তথ্য পুলিশের কাছে রয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাবের হাতেও রয়েছে তাদের সব তথ্য। কোন এলাকায় থাকে, কি করে, বয়স কত, কে কি অপরাধ করছে সব তথ্যই সংগ্রহ করা হয়েছে। কিশোরদের নামে মামলাও করা হয়েছে। তাদের বিচরণ করা এলাকায় পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, আমার এলাকায় কিশোর অপরাধীদের ধরতে নিয়মিত সাঁড়াশি অভিযান চলে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। সে যেই হোক রেহাই নেই। তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে।
সিএমপি সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি এলাকার উপর নজরদারি রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশও নজর রাখছে। কিশোর গ্যাংয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে পুলিশ।
ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ ও পতেঙ্গা থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া বলেন, কিশোর অপরাধী দমনে আমরা বদ্ধপরিকর। কিশোররা যাতে কোনোধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সতর্ক রয়েছি। যারা ইতিমধ্যে জড়িয়ে পড়েছে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।