নগরীতে আবারও ব্যাটারি চালিত রিকশার দৌরাত্ম্য

410

হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও নগরজুড়ে ব্যাটারি চালিত রিকশার দৌরাত্ম আবারও বেড়েছে। নগর পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ থেকে অভিযান চলমান থাকলেও তা কমানো যাচ্ছে না। এদিকে ব্যাটারি চালিত রিকশা বন্ধে পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত আবেদন দিয়ে ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে মহানগরীর প্যাডেল রিকশা মালিক পরিষদ। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হবে বলে জানান তারা।
সিএমপি’র ট্রাফিক বিভাগ জানায়, মহাসড়কে ব্যাটারি রিকশা চলতে দেয়া হয় না। যা চলছে তা অলি-গলিতে। সেখানে অভিযান চালানোর মত সক্ষমতা আমাদের নেই। গত এক সপ্তাহের অভিযানে ট্রাফিকের চার বিভাগ থেকে ৭২টি ব্যাটারি রিকশা জব্দ হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে।
অভিযোগ উঠেছে, টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে স্থানীয় নেতা ও পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব গাড়ি চলছে। আগে মহাসড়কে চললেও এখন অলি-গলিতে চলছে।
হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা : ২০১৮ সালে নগরে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে মহানগরী রিকশা মালিক পরিষদ ও অটো রিকশা অটো টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক সমিতি। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন।
সরেজমিন দেখা যায়, চকবাজার ধুনিরপুল থেকে সৈয়দ শাহ রোড ও বড় কবরস্থান হয়ে পুলিশ বিট, আব্দুল লতিফহাট থেকে চেয়ারম্যানঘাট এবং কোরবানিগঞ্জ থেকে কালামিয়া বাজার পর্যন্ত চলছে ব্যাটারি চালিত রিকশা। এ সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ মতো হবে। এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন মো. মামুন চৌধুরী, মুহিবুল্লাহ, মো. কুদ্দুছ এবং ধনু মিয়া নামে কয়েকজন।
মুহিবুল্লাহ বলেন, আমরা একটা সিন্ডিকেট করেছি। শফিক কোম্পানি, হানিফ কোম্পানিসহ ৮-১০ জন আছি। পুলিশকে কিছু দিয়ে ম্যানেজ করি। কত টাকা দেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা সামনাসামনি বলবো। আপনি ময়দার মিল এলাকায় আসেন, আপনাকেও কি করতে হয় করবো।
বাকলিয়া থানার ট্রাফিক পরিদর্শক মো. সামছুদ্দিন বলেন, প্রতিদিন গাড়ি জব্দ করছি। আমি দৈনিক ২০ টার উপরে জব্দ করছি।
বাকলিয়া থানার ওসি মো. রুহুল আমিন বলেন, টহল পুলিশের সদস্যরাই গাড়িগুলো জব্দ করে। বর্তমানে থানায় ১০-১৫টা ব্যাটারি রিকশা আছে। আর কেউ যদি আমাদের বিরুদ্ধে বলে, আমি চ্যালেঞ্জ করছি, ওই লাইনম্যানরা এসে বলুক।
চান্দগাঁও থানাধীন মৌলভী বাজার থেকে কালুরঘাট ব্রিজ এবং ওয়াসা রোড, পাঠাইন্না গোধা থেকে হামিদচর, ওসমানিয়াপুল থেকে সিএন্ডবি এর আশেপাশে পুরো এলাকা মিলে প্রায় ৩ হাজার ব্যাটারি রিকশা চলছে। ওইসব এলাকায় রিকশা নিয়ন্ত্রণ করেন মো. বেলাল, মহিউদ্দিন, লিটন, ইসমাঈল। চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় থানাকে প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা এবং ট্রাফিক পরিদর্শককে প্রতিদিন ২ হাজার টাকা দেয়া লাগে। লাইন নিয়ন্ত্রক ও ক্যাশিয়ার লিটন এ প্রতিবেদককে বলেন, আপনার সাথে বেলাল আর ইসমাঈল দেখা করেনি? আপনি এর আগে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন, তারপর আপনার সাথে কন্ট্রাক্ট করার কথা। তবে পুলিশকে আমি ম্যানেজ করি না, সব ইসমাঈল আর বেলাল করেন।
চান্দগাঁও থানার ওসি মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ব্যাটারি রিকশা সম্পর্কে জানতাম না। আমাকে নলেজে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। নতুন এসেছি, তাই জানি না। তবে আমার এলাকায় এসব চলতে পারবে না।
বায়েজিদ থানাধীন জামশেদ শাহ মাজার রোড, কুলগাঁও আবাসিক এলাকা হতে খাজা রোড, অক্সিজেন মোড় থেকে আঁতুরার ডিপু, চন্দ্রনগর, আরেফিন নগর, বাংলা বাজার টেক্সটাইল মোড় ও হিলভিউ আবাসিক, রৌফাবাদ কলোনি, বাংলাবাজার বশর কোম্পানির গ্যারেজ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ব্যাটারি রিকশা চলছে। ওইসব নিয়ন্ত্রণ করেন মো. সামছু, এনাম ও আকাশ।
তাদের মধ্যে মো. সামছু বলেন, আমি কোন লাইন চালাই না, রিকশা চালকরা মিথ্যা বলছে। সবাই আমাকে দোষারোপ করে। লাইন চালায় টেকনিক্যালের হেলাল, এনাম। বর্তমানে আমি কার চালাই।
বায়েজিদ থানার ওসি (তদন্ত) শহিদুল ইসলাম বলেন, থানাকে ম্যানেজ করার বিষয়টি আমি অবগত নই। সেটা ওসি স্যার বলতে পারবেন। তিনি এখন ছুটিতে আছেন।
খুলশী থানাধীন জালালাবাদ থেকে ওয়ার্লেস হয়ে সেগুনবাগান রেলস্কুল ও মামা-ভাগিনার মাজার পর্যন্ত, বিজিএমইএ ভবনের সামনে থেকে ঝাউতলা বাজার হয়ে আমবাগান রেলগেট ও সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে পলিটেকনিক মোড় পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ব্যাটারি রিকশা চলছে। ওই এলাকায় হেলাল, মো. জামাল উদ্দিন, জামাল (প্রকাশ পানি জামাল) ও মাঝি এসব নিয়ন্ত্রণ করেন।
তাদের মধ্যে মো. জামাল উদ্দিন বলেন, আমরা চুরি করে চালাই, সেটা ঠিক। তবে কোন লাইনের অধীনে নয়। আমি কোন টাকা-পয়সা নিই না।
নগরীর হালিশহর ও পাহাড়তলী থানাধীন ফইল্যাতলী বাজার থেকে সবুজবাগ পেট্রোল পাম্পের মুখ, হালিশহর বি-ব্লক শাহজাহান বেকারির সামনে থেকে আশপাশের পুরো এলাকা, শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে সাগরপাড়, বণিকপাড়া হরি মন্দির আইয়ুব খানের গ্যারেজ থেকে পাহাড়তলী থানা এলাকার সাগরিকা রোড, বেপারিপাড়া কাসেম কোম্পানির গ্যারেজ হয়ে আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার ২৯টি সড়ক পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার ব্যাটারি রিকশা চলছে।
হালিশহর-পাহাড়তলী থানা এলাকায় ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণ করেন ছানা উল্লাহ। তিনি বলেন, আমার ব্যাটারি রিকশা আছে, কিন্তু এ বিষয়ে ফোনে কিছু বলা যাবে না। সামনাসামনি বসবো, আপনাকে কি করতে হবে, তা করবো।
হালিশহর থানার ট্রাফিক পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে আমার মত মামলা কোন টিআই করে না। আমি মেইন রোডে কোন রিকশা চলতে দিই না।
হালিশহর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের সামনে পড়লেই মামলা দিচ্ছি, জব্দ করছি। কেউ আমাদের ব্যাপারে অভিযোগ দিলে দিতে পারে, তবে আমি এসব বিষয়ে জানি না।
ডবলমুরিং থানাধীন বিল্লাপাড়া পুলিশ বিট হয়ে ৯নং ব্রিজ ও ভাঙ্গা ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাধিক ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে। এসব নিয়ন্ত্রণে আছেন স্থানীয় শান্ত, কাশেম ও আলম। তারা বিল্লাপাড়া, বেপারিপাড়া ও রঙ্গীপাড়ায় আলাদাভাবে টাকা তোলেন। তবে তাদেরকে মুঠোফোনে কল দিলে কোন সাড়া দেননি।
ডবলমুরিং থানার ওসি মো. মহসীন বলেন, ডবলমুরিং এলাকায় কোন রিকশা নাই। আমার চোখে এখনো পড়েনি। সেগুলো নিষিদ্ধ, দেখলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।
এছাড়া ইপিজেড থানাসহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সড়কে আরও ২ হাজারের মত ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে। তবে সেগুলোর কোন সুনির্দিষ্ট লাইন পাওয়া যায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে গাড়িগুলো চলছে। অর্থাৎ পুরো নগরীতে সবগুলো মিলে ব্যাটারি রিকশা হবে ২০ হাজারের বেশি। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করে এলাকাভিত্তিক লাইনম্যান এবং গ্যারেজওয়ালা।
জানা গেছে, প্রতিটি ব্যাটারি রিকশার চালক থেকে দৈনিক ১৪০ টাকা চাঁদা তোলা হয়, যার মধ্যে ১০ টাকা গ্যারেজ ভাড়া, অর্থাৎ ১৩০ টাকা মূল চাঁদা। তাহলে ২০ হাজার ব্যাটারি রিকশা থেকে দৈনিক আদায় হয় ২৬ লক্ষ টাকা। আর টাকাগুলো বিভিন্ন মহলে গিয়ে ভাগভাটোয়ারা হয়।
এছাড়া পুরো নগরীতে ব্যাটারি রিকশার লাইন নিয়ন্ত্রণ করছেন ওয়াজি উল্লাহ নামের এক ব্যক্তি। তার অধীনে বিভিন্ন এলাকায় একজন করে লাইনম্যান রাখা হয়েছে।
নগরীর ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণকারী ওয়াজী উল্লাহ জানান, আমি ব্যাটারি রিকশা চলাচল করার জন্য একটা কমিটি করে দিয়েছি। তবে আমার একার কিছু নেই। ব্যাটারি রিকশার বৈধতা পাওয়ার জন্য হাইকোর্টে দৌড়াদৌড়ি করছি। তবে এলাকাভিত্তিক কে, কীভাবে ম্যানেজ করছে, জানি না।
মহানগরীর প্যাডেল রিকশা মালিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ব্যাটারি রিকশা বন্ধে মাননীয় পুলিশ কমিশনারকে ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছি। এর মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে কঠোর কর্মসূচি দিবো।
এ বিষয়ে সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ পূর্বদেশকে জানান, বিআরটিএ’র অনুমোদন ছাড়া কোন গাড়ি চলতে পারে না। কাজেই নগরে এগুলোর চলাচল সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। এসব ব্যাপারে কোন ছাড় নয়।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) মো. শামসুল ইসলাম জানান, বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি এবং দ্রæত ব্যবস্থা নিচ্ছি।