নগরীকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ব্যর্থ চসিক

26

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রাম ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর নগরী। এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার অনেক অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে। এই নগরীর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন সত্যিকার অর্থে নানান আর্থিক সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত থাকায় এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে উন্নীত করার মতো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এটাও সত্য যে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের অনেক সম্ভাবনার দুয়ার খোলা রয়েছে। নগরীর বেনিফিশিয়ারি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব আয় ও তহবিলের একটি অংশ বরাদ্দ নিশ্চিত হলে এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানের উন্নীত করার সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর হবে। সর্বোপরি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এবং বিভিন্ন সেবাখাতগুলোর কার্যক্রম যথাযথভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠবে।
তিনি গতকাল শনিবার টাইগারপাসস্থ চসিক সম্মেলন কক্ষে নান্দনিক, পরিবেশবান্ধব ও উন্নত চট্টগ্রাম নগরী গড়ার লক্ষে চসিক প্রশাসক কর্তৃক গঠিত পরামর্শক কমিটির প্রথম সভায় এসব কথা বলেন।
চসিক প্রশাসক ভৌগোলিক শহর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ার হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের নাম উল্লেখ করে বলেন, জাতীয় অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি আয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এ কারণেই চট্টগ্রামকে বলা হয় জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিন্ড। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রেও ৮০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই। এই চট্টগ্রাম থেকে সরকার যে ট্যাক্স নিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে শতকরা ১ শতাংশ দিলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তি সুদৃঢ় হয় এবং চট্টগ্রামের উন্নয়নে অন্য কারোর উপর নির্ভরশীলতা আর দরকার পড়ে না। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সড়কগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৫টন। কিন্তু ইপিজেড ও বন্দর কেন্দ্রিক পরিবহণগুলো ১০-১৫টনের বেশি মালামাল বহন করে থাকে। তাই তাদের পরিবহণগুলোর বাড়তি চাপে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এব্যাপারে ইপিজেড কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে এবং সড়ক কাঠামো উন্নয়নে তাদেরও একটি অংশগ্রহণ থাকা বাঞ্চনীয়। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে ট্যানেল করে দিচ্ছেন। এর সাথে রেললাইন যুক্ত হচ্ছে মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত। বে-টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে। এটি ভারত, চীনসহ সবাই ব্যবহার করতে পারবে। মহেশখালীতে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হয়ে গেলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব সিঙ্গাপুরের মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হবে। এ সমস্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলো থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির বিশাল উৎস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পরামর্শক কমিটির প্রধান সাবেক মুখ্য সচিব ও পিকেএসএফ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল করিম বলেন, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত আছে, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রকল্প বাস্তবায়নে সিটি কর্পোরেশন থেকে যে ম্যাচিং ফান্ড দিতে হয় তা কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি থোক বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও সদ্য সাবেক সিটি মেয়র আ.জ.ম. নাছির উদ্দীন বলেন, চলমান উন্নয়ন কাজ প্রক্রিয়ায় দেনা থাকাটাই স্বাভাবিক। এর সমাধান হতে হলে সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সক্ষমতা অর্জনে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওনাগুলো যাতে আদায় হয় সে ব্যাপারে সরকারকে সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান তৈরি করে দিতে হবে।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সিটি গভর্মেন্ট গঠন ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সার্বিক কর্তৃত্ব অর্জন অসম্ভব। কারণ চট্টগ্রামের উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সেবার সংস্থার সমন্বয়ের নেতৃত্ব সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়রের হাতে না থাকলে তিনি হবেন টুঁটো জগন্নাথ। তিনি চসিক প্রশাসকের উদ্দেশ্যে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাজের গতিশীলতার জন্য আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে চাইলে আমি সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রশাসক আমাদের দলের এবং মহানগর কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে নগরবাসীর সুখ-দুঃখের সাথে পরিচিত। তাই তিনি নগরবাসীর স্বার্থে যতটুকু সহযোগিতা চাইবেন দল থেকে তা দিতে আমরা অঙ্গিকারাবদ্ধ।
পরামর্শক কমিটির সদস্য দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, চট্টগ্রামের একজন সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে চট্টগ্রামবাসীর মনের কথাগুলো গুরুত্বের সাথে আমলে আনি। নগরবাসীর সমস্যা দুর্ভোগ সম্পর্কে অনেকের নানারকম কথা থাকে। এগুলো তুলে ধরতে হয়। এসব কথায় সমালোচনা যেমন থাকে তেমনি পরামর্শও থাকে। এতে কারো মনক্ষুণœ হওয়ার কোন কারণ নেই। বিগত মেয়রের আমলে দৈনিক আজাদী নগরবাসীর সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন এবং সমাধানের পরামর্শ দিয়েছি। প্রকাশিত সংবাদে প্রতিবাদকেও আমরা উপেক্ষা করিনি এবং তা গুরুত্বের সাথে পরিবেশন করেছি।
পরামর্শক কমিটির সদস্য, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নৌ-বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন কমডোর জোবায়ের আহমেদ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ৬ হাজার ৪ শত ৭৪ কোটি টাকা নিজস্ব তহবিল রয়েছে। এ থেকে মাত্র ১ শতাংশ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে দিলে চট্টগ্রামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি এমএ সালাম বলেন, প্রশাসক এই পরামর্শক কমিটি গঠন করে যে উদ্যোগ নিয়েছেন এর একটি ইতিবাচক সুফল আনতে হলে ব্যবসায়ী সমাজ থেকে যা করণীয় তা নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আজকে এই সভায় বিগত মেয়র সহ যে সকল গুণী ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে চিন্তার আদান-প্রদানে একটি আবহ তৈরি করেছেন।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও শিক্ষাবিদ হাসিনা জাকারিয়া বলেন, দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি করতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই সেই সাথে বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে। তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়ন চেতনার সাথে ৩টি ‘ম’ যুক্ত করতে হবে, এগুলো হলো মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ও মানবিকতা।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সভাপতি আলী আব্বাস বলেন, আজকে প্রশাসকের আহবানে আমরা সাড়া দিয়েছি। চট্টগ্রামের উন্নয়নে আমরা সবসময় পাশে থাকবো। আমি মনে করি চসিকের বড় বড় প্রকল্পের সাথে মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো সহসা বাস্তবায়ন হলে জনগণ উপকৃত হবেন।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এ্যান্ড এ্যানিমেল সায়ন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, নগরীর বেওয়ারিশ কুকুর থেকে মুক্তি পেতে চসিককে সহযোগিতা করতে চাই।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও নগর পরিকল্পনাবিদ ও রাশিয়ার অনারারি কনসাল স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, আমি প্রশাসকের আহব্বানে ঐতিহ্যবাহী লালদিঘীর পার্কটিকে সংস্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে সেখানে যুদ্ধবিধ্বস্থ চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করার জন্য যুদ্ধ পরবর্তী যে সকল সোভিয়েত ইউনিয়নের নাবিক প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে রেডকিন নামে যিনি ছিলেন তার স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। যার ফলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের পর বিদেশি নাগরিকের আত্মনিবেদনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সভাপতি প্রবীর কুমার সেন বলেন, বিগত মেয়রের আমলে নগরীর উন্নয়নে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছি। বিশেষ করে রাস্তার উপর পোলগুলো ছিল তা সরিয়ে দিয়েছি। এখনো আমি একজন প্রকৌশলী হিসেবে প্রশাসক মহোদয় যখন যে সহায়তা চাইবে তা প্রদানে আগ্রহী।
সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মো. মোজাম্মেল হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন চসিক সচিব মোহাম্মদ আবু শাহেদ চৌধুরী, প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমেদ পিএসসি, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুফিদুল আলম, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী, প্রশাসকের একান্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল হাশেম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এ কে এম রেজাউল করিম, অতিরিক্ত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরীসহ চসিকের অন্যান্য কর্মকর্তাগণ। খবর বিজ্ঞপ্তির