ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতি দ্রুত করতে হবে

28

এপ্রিল-মে মানেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাস। ১৯৯১ সাল থেকে যত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস হয়েছে প্রায় প্রতিটি এ দুইমাসের কোন একসময় হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৯ এপ্রিলকে এখনও ভয়াল কালো রাত বলা হয়। চট্টগ্রামের পুরো উপক‚লীয় অঞ্চলকে তছনছ করে গিয়েছিল সেই রাতে। ৩২ বছর পর এ চট্টগ্রাম দিয়েই আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়তে পারে আগামী রবি বা সোমবারের মধ্যেই-এমনটি আভাস দিয়ে যাচ্ছে আবহাওয়া অফিস। এটির নাম ‘মোখা’। ইয়ামেনের একটি বিখ্যাত শহরের নামে এ মোখা এখন বঙ্গোপসাগরের কাছেই অবস্থান করছে বলে আবহাওয়া বিশারদগন ধারণা করছেন। সূত্র জানায়, দেশের ওপর বয়ে যাওয়া তীব্র দাবদাহের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে লঘুচাপ, যা ঘনীভূত হয়ে ধাপে ধাপে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিচ্ছে। সহকারী আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুননেছা বলেন, বুধবার এটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়েছে। প্রথম দিকে উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলেও আজ ১১ মে ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে বাঁক নিয়ে উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে পারে। তবে সম্ভাব্য সেই ঘূর্ণিঝড় কবে কোন এলাকা দিয়ে উপক‚ল অতিক্রম করবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা স্পষ্ট হবে। সাগরে যখন ঝড়ের জন্ম হচ্ছে, দেশের অধিকাংশ এলাকায় বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। গত কয়েকদিন ধরে চলা এ তাপপ্রবাহ আরও দু-তিন দিন অব্যাহত থাকবে বলে জানান সহকারী আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুননেছা। গত ২৪ ঘণ্টায় চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায়, ২১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কাজী জেবুননেছা জানান, লঘুচাপের প্রভাবে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়বে, সেই সঙ্গে বাড়বে তাপপ্রবাহের বিস্তার। সরকার ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় দেশের সকল উপক‚লীয় এলাকার প্রশাসনকে সার্বিক নির্দেশনা প্রদান করেছে বলে জানা গেছে। আমরা মনে করি, সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা দুর্যোগ মোকাবেলায় শতভাগ সফলতা লাভ করে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগের ঘটনার পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বড় বড় দুর্যোগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যেমন ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্রায় এক কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ২০০৭ সালের বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় সোয়া কোটি মানুষ। ক্ষেতের ফসল, বাড়িঘর, গবাদি পশু, গাছপালা সবই ধ্বংস হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার সমুদ্র উপক‚লে প্রাণ হারায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩২০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.২ শতাংশ। চলতি শতকের ২০ বছরে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ নবম। প্রতিবছরই আমাদের দেশ ছোট-বড় কোনো না কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে বন্যা, জলোচ্ছ¡াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকেই। ফলে সরকারকে মাঠ পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণের কাজ করতে হয়। একটি রাষ্ট্রে কতসংখ্যক মানুষ বসবাস করে, কার নাম কী, কার মাসিক আয় কত, কার পেশা কী- এ বিষয়ে একটি ডাটাবেইস করা কঠিন হলেও কাজটি একেবারে অসম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন বাহিনীর সহযোগিতায় দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে এই কাজটি একবার সম্পন্ন করতে পারলে নানা দুর্যোগের মুহূর্তে সরকারের যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রম এবং দুর্যোগকালীন যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হবে। এমনকি বিদ্যমান স্মার্ট কার্ডের (জাতীয় পরিচয়পত্র) ব্যাপ্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আট বছর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জাতীয় খানা জরিপ (এনএইচডি) প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি তালিকা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। জরিপের কাজও শেষ, কিন্তু তালিকাটি এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ওই তালিকা হলে দুর্যোগের সময়ে ত্রাণ বিতরণ কিছুটা সহজ হতো। শুধু দরিদ্রদের কিংবা ভাসমানদের নয়, পুরো দেশের জনসংখ্যাকে একটি জাতীয় ডাটাবেইসের আওতায় আনতে পারলে শুধু ত্রাণ বিতরণ নয়, বহুমুখী সমস্যা সমাধানে জাতীয়ভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। কারণ অনাকাক্সিক্ষত হলেও দুর্যোগ একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে অপ্রত্যাশিত নানা রকম সংকট ও দুর্যোগের কার্যকর সমাধানের লক্ষ্যে টেকসই ও স্থায়ী প্রস্তুতি হিসেবে একটি জাতীয় ডাটাবেইস তৈরির বিষয়ে সরকার গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।