ধেয়ে আসছে ‘আম্ফান’

132

তুষার দেব
রুদ্র বৈশাখের শেষপক্ষে এসে প্রবল গতিতে ধেয়ে আসতে চলেছে মৌসুমের প্রথম ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’। শুরুতেই এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূল হয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আজ রবিবার থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এটি আছড়ে পড়তে বলে মনে করছেন সেখানকার আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আগামী ৫ মের পর তার গতিপথ কোনদিকে পরিবর্তন করে সে দিকেই চেয়ে রয়েছে সংস্থাটি।
করোনা মহামারি অব্যাহত থাকা অবস্থায় ধেয়ে আসা বছরের এই প্রথম ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল, গতিপথ এবং শক্তিমত্তা নিয়ে আবহাওয়াবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে এটি যে যথেষ্ট শক্তিশালী এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলে যে কমবেশি আঘাত হানবে তা নিয়ে প্রায় সকলেই একমত প্রকাশ করেছেন। আবহাওয়াবিদদের কেউ কেউ বলছেন, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের বেশ কিছু এলাকাজুড়ে তৈরি হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। আর সেটি কিছুটা ‘সিডরের’ গতিপথ অনুসরণ করতে পারে। দেশের উপকূলীয় পটুয়াখালি, বরিশাল, বরগুনা, লক্ষীপুর ও ফেনীতে এটি ক্যাটাগরি-৪ মাত্রার শক্তি নিয়ে আঘাত করতে পারে। যদিও ঘূর্ণিঝড়টি সর্বোচ্চ ক্যাটাগরি- ৩ মাত্রার হবে এবং ক্যাটাগরি- ২ মাত্রার শক্তি নিয়ে সুন্দরবনে আঘাত হানতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টি মধ্য বঙ্গোপসাগরে এসে শক্তি সঞ্চয় করতে পারে এবং যতই উত্তর পশ্চিমে অগ্রসর হবে ততই শক্তি অর্জন করতে থাকবে। এটি উড়িষ্যা উপকূলের কাছাকাছি সর্বোচ্চ শক্তি অর্জন করতে পারে-এমন পর্যবেক্ষণও রয়েছে।
অনেকে আবার এও বলছেন, ঘূর্ণিঝড়টি আন্দামান দীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্টি হয়ে খুব দ্রুত শক্তি বাড়িয়ে উত্তর পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে ভারতের পূর্ব উপকূল ঘেঁষে উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ক্যাটাগরি-৪ মাত্রার শক্তি নিয়ে আঘাত করতে পারে। আরেক পক্ষের দাবি, এটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি করতে করতে মধ্য বঙ্গোপসাগরের দিকে যেতে পারে এবং আগামী ছয় মের মধ্যে স্পষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। এরপর সামান্য কিছুটা পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে উত্তর দিকে বাঁক নিতে পারে এবং শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে (ক্যাটাগরি ৩ প্লাস) পরিণত হতে পারে। সর্বশেষ আগামী ১২ ও ১৩ মে নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বরিশাল পর্যন্ত যে কোনও এলাকা অতিক্রম করতে পারে। উপকূল অতিক্রমের পূর্বে কিছুটা দুর্বল হতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গের আলীপুর আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, ঘূর্ণিঝড়টি মধ্য-বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে তা সর্বোচ্চ ক্যাটাগরি- ৩ শক্তি নিয়ে চট্টগ্রাম উপকূলে দিকে অগ্রসর হয়ে ক্যাটাগরি-২ এ নেমে আঘাত আনতে পারে। সংস্থাটি ইতিমধ্যে সতর্কবার্তা জারি করেছে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জেলায়।
দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর অবশ্য গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত তার পূর্বাভাসে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত কোনও তথ্য কিংবা আভাস দেয়নি। যদিও মৌসুমের স্বাভাবিক নিয়মে পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় চট্টগ্রামসহ দেশের সবকটি বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় কমবেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে ময়মনসিংহে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে ফেনীতে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া এবং বিজলী চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আবহাওয়া গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন সংস্থার নথিপত্র এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে জানা গেছে, এপ্রিল বা মে মাসের প্রথমার্ধে ঘূর্ণিঝড়গুলোর বেশিরভাগই বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমার উপকূলেই আঘাত হানে। এর মধ্যে কেবল গতবছর সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ ব্যতিক্রম ছিল। যা এপ্রিলের শেষদিকে ভারতের উড়িষ্যা উপকূলকে লন্ডভন্ড করে দেয়। যদিও বাংলাদেশ উপকূলে এসে পৌঁছানোর আগেই ফণী শক্তি হারিয়ে অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায়। আর দেশের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এ্যান’ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় দুইশ’ ৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ছয় মিটার অর্থাৎ ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয় এবং এতে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এদের বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের মহেশখালী এবং নোয়াখালির হাতিয়ায় নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। এর মধ্যে শুধু সন্দ্বীপে প্রাণহানি ঘটে ২৩ হাজার মানুষের। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে কর্ণফুলী নদীর তীরে কংক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের একশ’ টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট-বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও ছিল। ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’ ক্যাটাগরি-৪ ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। স্থলভাগে ধ্বংসলীলা চালানোর পর এটি ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে পরদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই ঘুর্ণিঝড়ের দুঃসহ স্মৃতি উপকূলের মানুষ আজও ভুলেনি। প্রতিবছর কালবৈশাখীর মৌসুম এলেই উপকূলের মানুষের মনে অজানা শঙ্কা ভর করে।
উল্লেখ্য, চলতি মৌসুমে সৃষ্টি হতে যাওয়া প্রথম ঘুর্ণিঝড়ের আম্ফান নামটি দিয়েছে থাইল্যান্ড। আম্ফান ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় তালিকার শেষ নাম। ‘নর্দান ইন্ডিয়ান ওশেন সাইক্লোন’-এর আওতাভুক্ত আটটি দেশের প্রস্তাবিত নাম থেকেই তা পর্যায়ক্রমে রাখা হয়। আওতাভুক্ত দেশগুলো হল- বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। ওই পর্যায়ক্রমের আট নম্বর তালিকায় শেষ নামটি হল আম্ফান।