ধূসর জীবন

32

মোহাম্মদ হোসেন

চশমার ফ্রেমটা ভেঙ্গে গেছে। পাল্টাতে হবে। গ্লাসও নিতে হবে নতুন। অতিদ্রুতই। চশমা ছাড়া এখন এই চল্লিশোত্তর জীবনে চলে না। এমনিতে দরকার হয় না। কিন্তু কোনো বই বা বাজারের লিস্ট পড়তে গেলে, পেপার পত্রিকা হাতে নিলে, বা জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ মোবাইল দেখতে গেলে চশমা বিনে সম্ভব না। এদিকে আকাশে কালো মেঘেরাও জড়ো হয়েছে দেখছি। বৃষ্টি হবে কি? হতে পারে। ভারী বর্ষণও নেমে আসতে পারে। অসম্ভব কিছু না। গত কয়েকদিন হয়েছে। কাল পরশু বাদ গেছে। আজ আবারও হতে পারে। না-ও পারে।
ফোল্ডিং ছাতাাঁ হাতে নিয়ে নিলাম। করোনা থেকে সুরক্ষা হিসেবে নেকাব পড়লাম মুখে। পকেট সাইজ হ্যান্ড স্যানিটাইজারটা না নেয়া ঠিক হবে না। হাতে গ্লাভস পরবো? পরি। সাবধানতা অবলম্বন জরুরী। সমস্যা হলো, গ্লাভসের ভেতরে হাতের বুক পিঠ ঘেমে থাকে। অস্বস্তিকে সঙ্গী করে পথ চলতে হয়।
রাস্তার ওপাশে আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধু থাকে পরিবার নিয়ে। সমবায় অফিসার। পোস্টিং দাগনভূঁইয়া, ফেনী। বিষুদবার অফিস করে বিকেলে চলে আসে। যায় রোববার সকালে ভোরে ভোরে। আজ তো শনিবার। কল দেবো ওকে? ডাকলে নেমে আসবে পাঁচতলা থেকে হরহর করে। দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে। আবার ভাবছি, না থাক। ও পরিবারকে সময় দিক। বউ বাচ্চারা ওর সান্নিধ্যে মেতে থাকুক। আমি একাই যাই। এমুহূর্তে একা থাকতেই মন চাইছে। জীবনের অনেকটা পথ তো একা একাই পাড়ি দিতে হয়।
রিকশা নিতে মন চাইলো না। প্রৌঢ় জীবনের শুরুতে হাঁটাহাঁটি বেশি জরুরী। পা চালিয়ে দিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখলাম, সাত আটজনের একটা দল দোয়া পড়তে পড়তে একটা খাটিয়া কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলো শান্তিধারা আবাসিক এলাকার গলি থেকে। আজ ভোরে পাড়ার মসজিদ থেকে এই লোকের মৃত্যুর কথাই প্রচার করা হয়েছে। শুনেছি, একেবারেই তরুণ যুবা। করোনার অগ্নিতাপে ভাজাভাজা হয়ে গেছে কোটিপতি পিতার একমাত্র আদরের ধন সদ্য বিবাহিত এই তরতাজা প্রাণ।
ওদেরকে যেতে দিয়ে আমি গলির ভেতর ঢুকে পড়লাম। এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। সুন্দর রাস্তা। দুই পাশে উঁচু উঁচু আধুনিক স্থাপত্যের বিল্ডিং। হাঁটতে ভালো লাগে। কিছুদূর যাওয়ার পর বিলাপধ্বনি কানে এলো। কোনো মহিলা কাঁদছেন। ধারণা করছি, যে যুবকটির শুক পাখি উড়ে গেছে তার দেহখাঁচা থেকে, যে কিনা স্বজনদের কাঁধে চড়ে এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার কবরের নিঃসঙ্গ জীবনের দিকে, তাদের পরিবারেরই কেউ সশব্দ কান্নায় গড়াগড়ি খাচ্ছে সব হারানোর বেদনায়। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুকের জমিন ভেদ করে, আহা, যার ঘা তার পোড়া।
হাঁটতে হাঁটতে অপর প্রান্তে বাটা গলির মুখ দিয়ে বের হয়ে প্রশস্ত রাজপথের ফুটপাতে পা দিয়েই দেখি, শতশত গাড়ি চলছে হর্ণ বাজিয়ে জোর আওয়াজে। তার মধ্যে আছে দুটো এম্বুল্যান্স। হয় রোগী নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে, নয়তো লাশ পৌঁছে দিচ্ছে তার বাড়ির ঠিকানায়।
আমার গন্তব্য জিইসি মোড়। পাঁচ ছয়টা চশমার দোকান আছে সেখানে। সেদিকেই হাঁটছি আপন খেয়ালে। মানুষের সংস্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। জটলার মতো কিছু দেখলে এড়িয়ে যাচ্ছি। কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তা পার হবো বলে। মুখের মাস্কটা একটু নেমে গিয়েছিলো। ওটাকে জায়গামতো পৌঁছে দিচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ ডান পায়ে কিছু একটার স্পর্শে আমি চমকে উঠলাম। ভাবলাম কী না কী। চেয়ে দেখি, এক পঙ্গু ভিক্ষুক মহিলা হাত বাড়িয়ে আছে সাহায্যের আশায়। কঠিন চোখে রাগতে গিয়েও পারলাম না। লজ্জিত হলাম বরং নিজের কাছে। আমি তো ওই নষ্ট মানুষেরই জাতভাই, যে কিনা কয়েক পেগ নিষিদ্ধ শৃঙ্গার রস পান করবে বলে এক বারোভাতারি উর্বশীকে তিন কোটি টাকা দামের নতুন মডেলের গাড়ি উপহার দিতে পারে। অথচ অভাবী মানুষকে তিনশো টাকা দান করতে গেলে হাত কাঁপে, বুক কাঁপে থরথর করে। আসলে আমরা মিঞার বেটারা ভাত খাইতে চাই না, খাট্টার লাগি কান্দি।
রাস্তা পার হয়ে একটা দোকানে ঢুকে দেখি, দশ বারোজন কাস্টমার সামাজিক দূরত্ব না মেনে ভীড় করে আছে। গেলাম পাশের দোকানে। ওখানেও একই অবস্থা, স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে অনাস্থা। কারো মুখে মাস্ক আছে, কারো মুখে নেই। থাকলেও কোনো কোনোটা আবার ঝুলে আছে থুতনির নিচে। একটা কথা ভেবে আমি কোনো ক‚ল-কিনারা পাই না, চারিদিকে অতিমারিতে এতো এতো মৃত্যু ও আক্রান্তের সংবাদ শোনা গেলেও মানুষ সচেতন নয়। কেনো? দেশের মানুষ কি তাহলে করোনার ভয়কে সত্যি সত্যি জয় করে ফেলেছে? করোনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলতে চাচ্ছে, এই দ্যাখ বেটা, ভাঙতে পারি লোহার কড়াই? নাকি দেখাতে চাচ্ছে, আমরা বীর বাঙালী, জীবনে বহুবার মরি না, একবারই মরি?
আমি ভাই বীরপুরুষ না। তাই গাদাগাদি না করে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। প্রায় দশ বারো মিনিট পর ফাঁকা পেয়ে দোকানদারের কাছে গেলাম। দেখলাম, উনিও বীরপুরুষ। কিন্তু আমাকে তো আমার প্রয়োজন মেটাতে হবে। উনাকে সমস্যার কথা বললাম। উনি অনেকগুলো ফ্রেম আমাকে দেখালেন। আমি একটা চয়েস করে দিতেই বললেন, ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। ঘুরে আসেন।
অগত্যা কী আর করা। আমি মাঠে নেমে পড়লাম। খই ভাজতে হবে তো। তবে খই ভাজার জন্য সাথে একজন সই থাকলে ভালো হতো। একঘন্টা সময় চক্ষের পলকে উড়ে উড়ে চলে যেতো। হাহ্ জীবন, অঢেল কড়িও ফেলতে পারবো না, কোনো অপ্সরা মডেলও কপালে জুটবে না।
এই ভাবতে ভাবতে যখন ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি আনমনে, তখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম এক গোলাপ-সুন্দরীর কাঁটার গুতো খেয়ে, চোখদুটো কি পায়ের তলায় নিয়ে হাঁটছেন? দেখে চলতে পারেন না?
মরমে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার। ছোট একটা পাথরের সাথে হোঁচট খেয়ে আর একটু হলে মেয়েটির গায়ের উপর গিয়ে পড়তাম। কোনোরকমে বললাম, সরি।
‘রাবিশ’ বলে মনের ঝাল মিটিয়ে মেয়েটি চলে গেলো। ওর কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেলো একসময়কার প্রবল প্রতাপশালী অর্থমন্ত্রীর কথা, যিনি কারো কোনো কথা পছন্দ না হলেই বলতেন, রাবিশ। কাল ফেসবুকে দেখলাম, তিনি বেডে শুয়ে আছেন। অসুস্থ। বড্ড অসহায় অবস্থা। কাছেপিঠে আপনজন কেউ নেই। রোগাটে শরীর। নেই আগের সেই জৌলুশ। শরীরটা কুঁকড়ে আছে। পায়ের নিচে বালিশ দেয়া। আহা রে জীবন! সময় নামক ঘোড়ায় চড়তে চড়তে মানুষ কতো বুড়িয়ে যায়, হয়ে পড়ে অসহায়! মহামতি বিজ্ঞানও এখানে নিরুপায়।
হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় গিয়ে দেখি, ছোট্ট একটা চত্বরে জনা দশেক লোকের একটা মিনি সমাবেশ। স¤প্রতি এক নায়িকা বেশধারী বারাঙ্গনাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তারা ওর মুক্তি দাবী করছে। আমি হাসবো, না কাঁদবো নাকি ভাবতে বসবো ভেবে পাচ্ছি না। দুর্মুখেরা বলে, এই রম্ভা নায়িকা টাকার বিনিময়ে নষ্ট বড়লোকদের দেহ ও মনের বিনোদনের জন্য আপন সুখ-সাগরের ঘাটকে উন্মুক্ত করে দিতো। শুধু তাই না, বিদেশী এক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ওর সুন্দর দেহতরীকে ইজারা দিয়েছে। ওই সংস্থার লোকজন ওকে ব্যবহার করেছে হানি ট্র্যাপ হিসেবে। অর্থ ও ক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবীতে যারা আছে তাদের অনেকে নিজেদের পরকীয় কামপ্রবৃত্তিকে তুষ্ট করতে গিয়ে গোয়েন্দাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। এসবের ভিডিও ক্লিপকে তারা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তাদের দেশের পক্ষে স্বার্থ আদায় করে নিতো। আমার কথা হলো, এই উর্বশী মেয়েটির শাস্তি হউক। পাশাপাশি যে সমস্ত কুলাঙ্গার মধু খাওয়ার লোভে তার দেহ-নৌকার যাত্রী হয়ে নীতিনৈতিকতা ও দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হউক।
আমার মনে হয়, নায়িকার মুক্তি দাবী পরোক্ষভাবে রাঘব বোয়ালদের আইনের আওতায় আনার বিষয়টিকে দৃশ্যকল্পের বাইরে নিয়ে যাওয়ারই নামান্তর। এটা হয়তো ওদের পক্ষ থেকেই চালা একটা সূ² চাল।
মনটা খারাপ ছিলো, এসব দেখে আরও খারাপ হয়ে গেলো। আরও খারাপ হলো যখন মনে পড়লো, আজ সকালেই পত্রিকায় পড়লাম দেশের সতেরোজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ওই নায়িকার মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। আসলে এদেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সম্প্রদায়, আমার জানা মতে, সুশীলতার চাদর গায়ে দিয়ে সুশীলতাকেই ছুঁড়ে মারে ডাস্টবিনে, পথ হারিয়ে পথ খুঁজে এবং অন্ধক‚পে সাগরের বিশালতা খুঁজে ফেরে। লেখক আহমদ ছফা ঠিকই বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের কথা ধরে চললে দেশ স্বাধীন হতো না এবং তাদেরকে গণনায় ধরলে দেশ সামনের দিকে আগাবে না।
হাতঘড়ি নেই। সেলফোনের দিকে চেয়ে দেখি, একঘন্টার বেশি সময় খরচা হয়ে গেছে। শুরু করলাম উল্টো দিকে হাঁটা।
নতুন চশমা নিয়ে বিল পরিশোধ করে যখন বেরিয়ে আসি দোকান থেকে, তুমুল বৃষ্টির হুলুস্থুল কারবার শুরু হয়ে গেছে চারদিকে। আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি যাকে বলে। বাতাসও আছে প্রবল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একটা খালি রিকশা পেয়ে উঠে পড়লাম। সীটের সামনে ঝুলিয়ে রাখা প্লাস্টিকের পর্দায় যে খুব একটা কাজ হচ্ছে তা নয়। অনেকটা আধভেজা হয়েই পৌঁছে গেলাম ভাড়া বাসার গেইটে। নেমে পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে বললাম, কত?
বয়সে তরুণ রিকশাচালক মাথা ও মুখের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, দেন মামা। আপনের খুশি।
তিনটা দশ টাকার নোট আমি ওর হাতে তুলে দিলাম। সে টু শব্দ না করে পকেটে পুরলো।
সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে অস্বস্তি শুরু হলো আমার মনে। রিকশাচালককে কি ঠকিয়েছি আমি? স্বাভাবিক সময়েই ভাড়া ত্রিশ টাকা। এই ঝড়ঝাপটার দিনেও তাই দিলাম! বাড়তি এক টাকাও দিলাম না! মনে হচ্ছে, ওর উদারতাকে আমি হাত-পা বেঁধে নিষ্ঠুরভাবে বলাৎকার করেছি। ছিঃ।
মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো।
আহা, মন খারাপের বুঝি শেষ নেই।