ধর্ষণ ঠেকানোর লড়াইয়ে অ্যাপ বানালেন তিনি

11

ধর্ষণের শিকার হয়েছিল বোন, সেই থেকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে নারীদের এমন ঘটনা থেকে রক্ষার জন্য ‘বাঁচাও’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করেন তিনি। কোনো নারী যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়েন, যা ধর্ষণের ঘটনায় মোড় নিতে পারে, তখন এই অ্যাপটির মাধ্যমে তিনি সহায়তা চাইতে পারবেন।
‘বাঁচাও ডট লাইফ ফাউন্ডেশন’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জালাল আহমেদ জানান, প্রেম করে বিয়ের পর ২০০১ সালে তার বোনকে ‘বিক্রি’ করে দিয়েছিলেন তার স্বামী। এরপর তাকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, ‘ধর্ষণকারীরা তাকে হুমকি দিয়েছিল হত্যার পর মর্গে তার মৃতদেহকেও ধর্ষণ করা হবে। ওই দিন থেকে আমার বোন আর কোনো কথা বলেনি। আমার মা এই আঘাত সইতে পারেনি। ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগে তিনি মেয়েদের রক্ষা করার জন্য কিছু একটা করার জন্য বলেন। তিনি বলেছিলেন- তুমি একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, এমন পৈশাচিক ঘটনা থেকে অন্তত একটা মেয়েকে রক্ষার জন্য হলেও কিছু একটা কর’।
মায়ের মৃত্যুর পর জালাল ধর্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বাঁচাও ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে গবেষণার কাজে হাত দেন। যেখানে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রয়েছেন।
অবশেষে নারীরা যাতে প্রয়োজনের সময়, বিশেষ করে ধর্ষণ থেকে নিজেদের রক্ষায় সহায়তা চাইতে পারে, সেজন্য ‘বাঁচাও’ নামে অ্যাপটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। গত আগস্টে সীমিত আকারে অ্যাপটি চালু করা হয়।
গত ২ অক্টোবর থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে এপর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষ তা ডাউনলোড করেছেন। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশই ঢাকার বাসিন্দা এবং এর পরেই রয়েছেন চট্টগ্রামের বাসিন্দারা।
জালাল আহমেদ বলেন, ‘৮০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনাই নারীটির আশেপাশের কোনো স্থানে ঘটে এবং সেটা তার আবাসস্থল থেকে বেশি দূরে হয় না। আমরা দেখেছি, একমাত্র সমাজের সবাই এগিয়ে এলেই ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব, কারণ তারাই দ্রæত ঘটনাস্থলে যেতে পারে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে, কিন্তু কোনো নারীর যখন সহায়তা দরকার হয় তখন সবখানে তাদের পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে ৮০০ জনের জন্য একজন পুলিশ সদস্য রয়েছে। কাউকে সহায়তা করার জন্য তাদের পক্ষে কী দূর থেকে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানো সম্ভব? একমাত্র সমাজের লোক কিংবা স্বেচ্ছাসেবকরাই দ্রæত সহায়তা করতে পারবেন’।
তিনি জানান, কোনো ধরণের প্রচার শুরু করার আগেই অন্তত ১২ হাজার মানুষ অ্যাপটি ডাউনলোড করেন এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন। যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই তরুণ এবং শিক্ষার্থী। এই অপরাধ ঠেকাতে লোকজন আমাদের সহায়তা করতে চায় এবং তাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।
‘জানালা’ নামে সাহিত্য বিষয়ক একটি ফেসবুক পেইজের মডারেটর লেখক শেপু চৌধুরী বলেন, ‘আমি অ্যাপটি ডাউনলোড করেছি এবং গ্রুপেও শেয়ার করেছি। নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে এই অ্যাপটি কাজ করলে সেটা আমার গর্ব। এই প্রথমবারের মতো আমাদের গ্রুপে কোনো একটি অ্যাপের প্রচার করা হলো। এটা আমরা আমাদের সামাজিক দায়বোধের জায়গা থেকে করেছি’।

প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে ধর্ষণ
আইন ও শালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ৭৬৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৫ জন আত্মহত্যা করেছে।
সংস্থাটি জানায়, ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪১৩ জনে। তবে এটা প্রকৃত সংখ্যা নয় জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক ঘটনারই কোনো সংবাদ হয় না।
জালাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা যখন গবেষণা চালাই তখন অনেকেই জানিয়েছেন, বিশেষ করে নারী অধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, ধর্ষণের সব ঘটনা জানা যায় না। এর পেছনে রয়েছে সমাজে কলঙ্কিত হওয়ার ভয় এবং সুরক্ষার অভাব’।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা অর্ধেক কমিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ২০২২ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ধর্ষণের সংখ্যা দিনে ১৭ জন থেকে ৮ জনে নামিয়ে আনতে চাই। এটা ধর্ষণের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ। আমরা ৬৪ জেলাতেই কাজ করছি এবং প্রতিটি গ্রামে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। ২০২২ সালের মধ্যে ধর্ষণের বিশ্ব র‌্যাংকিংয়েও বাংলাদেশের অবস্থানকে আমরা উপরে তুলতে চাই’।
সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে বাঁচাও ডট লাইফ ফাউন্ডেশন প্রধান জানান, ইতোমধ্যে সহায়তা চেয়ে ধর্ষণের হাত থেকে নারীদের রক্ষা পাওয়ার মতো ৬০টি ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া পাঁচটি ঘটনায় সহায়তা চাওয়া নারী অ্যাপের সিস্টেমের বাইরে চলে গেছেন, এমন ক্ষেত্রে তার ফোনটি কেড়ে নেওয়া হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তাদের সন্ধান করার জন্য এবং কোনো সহায়তা করা যায় কি না, তা দেখার জন্য আমরা স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠিয়েছিলাম। খবর বিডিনিউজের

কীভাবে কাজ করে ‘বাঁচাও’ অ্যাপ
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাঁচাও অ্যাপ। যেখানে একটি মাত্র ছোঁয়ায় সমস্যায় পড়া একজন নারী তার কাছাকাছি স্বেচ্ছাসেবক, পরিবার, বন্ধু অথবা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান।
এই অ্যাপসটি সহায়তা চাওয়া নারীর অবস্থান নির্দেশ করবে এবং এর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে টেক্সট কিংবা অডিও’র মাধ্যমে তার যোগাযোগ স্থাপন করবে। গুগল প্লে স্টোর থেকে অ্যাপটি ইনস্টল করার পর জরুরি যোগাযোগের জন্য পরিবার এবং বন্ধুদের ফোন নম্বর নির্বাচন করতে হয়। যদি কোনো নারী ধর্ষণের আশঙ্কা করেন তবে তিনি ‘রেপ অ্যালার্ট’ লেখা লাল বোতাম চাপলেই হবে।
কাছাকাছি থাকা স্বেচ্ছাসেবকরা ওই সতর্কবার্তা পেয়ে যাবেন এবং তারা ‘মেসেজ’ দিয়ে যোগাযোগ করবেন কিংবা ওই নারীকে সহায়তার জন্য ফোন করবেন। ওই নারীও পাল্টা যোগাযোগ করতে পারবেন।
নিজেকে নিরাপদ মনে করলে ওই নারীকে ‘সেইফ নাউ’ লেখা সবুজ বোতামে একবার চাপ দিতে হবে। এছাড়া ‘বাঁচাও’ হেল্পলাইনে যে কেউ ফোন করতে পারবেন।
এই কার্যক্রম চালাতে বাধার বিষয়ে জানতে চাইলে জালাল আহমেদ জানান, প্রথম বাধাটি ছিল গুগলের কাছ থেকে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং তথ্য সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কার কারণে সাতবার তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে গুগল।
তিনি বলেন, ‘অ্যাপটিতে একটি কন্টাক্ট সেট করতে হয় যা স্বেচ্ছাসেবক এবং ঘটনার শিকার নারীর যোগাযোগের বার্তাগুলো রেকর্ড করবে। এতে অবশ্যই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কারণ দেখিয়ে অনেকে আপত্তি তুলবেন। তবে সবশেষে আমরা অ্যাপটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য বোঝাতে সক্ষম হয়েছি এবং গুগুল আমাদের অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া ব্যবহারকারী কোনো কলে যোগ দিতে চায় কি না কিংবা তা রেকর্ড করা হবে কি না তার অনুমোদন চাইবে এই অ্যাপ’।
যেহেতু ব্যবহারকারীরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং কোন স্থানে আছেন সেটা শেয়ার করবেন তাই ‘বাঁচাও’ অ্যাপ কিছু নীতিমালা মেনে চলবে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রধান। তিনি বলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তার জন্য কলগুলো ‘অ্যাপ থেকে অ্যাপ’ এ যাবে তাই কোনো ফোন নম্বর দেখাবে না’।
‘বাঁচাও’ অ্যাপ কেবল অ্যান্ড্রয়েড ফোনেই ব্যবহার করা যাবে। অ্যাপটি যারা তৈরি করেছেন তারা মনে করেন, আইফোন ব্যবহারকারীরা সাধারণত নগরে বসবাস করায় একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় নিরাপত্তা তারা পেয়ে থাকেন।
জনসংখ্যার বড় একটা অংশই গ্রামে বাস করায় এবং তাদের স্মার্টফোন না থাকায় প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের এই প্রতিষ্ঠান সহায়তা করতে পারবে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। জবাবে জালাল আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার অবশ্যই বেড়েছে কিন্তু সেটা প্রত্যেকেরই আছে এমনটা নয়। ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের কাছে পৌঁছাতে আমরা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন বিটিআরসির কাছে একটি ‘শর্ট কোড’ এর জন্য আবেদন করেছি। আমরা আশা করি আগামি নভেম্বরের মাঝামাঝি কোডটি প্রকাশ করতে পারব। শর্ট কোড হচ্ছে এমন একটি নম্বর যেখানে প্রচলিত মোবাইল ফোন থেকে কোনো ব্যক্তি কল করতে পারবেন এবং এসএমএসও পাঠাতে পারবেন। সহায়তা চাওয়ার জন্য ন্যূনতম স্বাক্ষর জ্ঞান থাকলেই চলবে’।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশীদার
ধর্ষণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে আরেকটি অংশীদার পেয়েছে বাঁচাও ডট লাইফ ফাউন্ডেশন। জালাল আহমেদ বলেন, ‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে আমাদের চেষ্টার কথা তুলে ধরেছি। তারা আমাদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে দিয়েছে।
বাঁচাও ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও শালিশ কেন্দ্র, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং জাগো ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠন এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলো কাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘আমরা বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং যে কোনো ধরণের সহায়তা করতে চেয়েছেন। তারা নিজদের পরিবার ও বন্ধুদের অ্যাপটি ব্যবহার করার জন্য প্রচার চালিয়েছেন’।
তিনি জানান, বাংলাদেশে নারীরা নানা ধরণের চ্যালেঞ্জ এবং সহিংসতার মুখোমুখি হয়। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি দরকার হলেও এই মুহূর্তে সেটা যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যতে আমরা অন্যান্য আরও বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই কিন্তু শুরুতে আমরা আমাদের নারীদের ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে চাই’- বলেন বাঁচাও ফাউন্ডেশনের প্রধান।