ধর্ষণরোধে মৃত্যুদন্ড ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

47

কামাল আহমেদ

দেশে দীর্ঘদিনের চলমান ও পুঞ্জীভূত সমস্যার সাথে হঠাৎ করেই মহামারী আকারে যুক্ত হল ধর্ষণ ও নির্যাতন বা হত্যা। দেশব্যাপী অসহিষ্ণু অবস্থায় ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করার দাবি নিয়ে সবাই আন্দোলনে সোচ্চার। এমনকি সরকার পক্ষও একমত, পত্রপত্রিকা বা মিডিয়াতে সুধীজনের মতামতও এমনই। ইতোমধ্যে মন্ত্রীসভায় এমন একটি আইনের সংশোধনী বিল আনা হয়েছে। শেষপর্যন্ত মৃত্যুদন্ডর অধ্যাদেশ জারি করে তা আইনে পরিণত হয়েছে। একইসাথে ১৮০ দিনে বিচারকার্য সম্পাদনের আইনও করা হয়েছে। দ্রুতবিচার খুব জরুরি। কিন্তু আইন সংশোধনের পরেও পত্রপত্রিকায় ঠিক আগের মতই কমবেশি ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে, শৃঙ্খলার অবনতি দেখা যাচ্ছে। আন্দোলনে বা প্রকাশিত মতামতে মনে হয়েছিল মৃত্যুদন্ড ই একমাত্র সমাধান। কিন্তু আসলেই কি এতেই ধর্ষণের ঘটনা হাওয়া হয়ে যাবে? সমাজ-পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে যাবজ্জীবন বেড়ে মৃত্যুদন্ড হয়েছে, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যার সমাধান কি হবে?
মাত্র ক’দিন আগেই মেজর সিনহার হত্যাকান্ড দেশবাসীকে কাঁদিয়েছে, বাকরুদ্ধ করেছে। কিছুদিন আগে এমসি কলেজে এক নববধূর স্বামীকে বেঁধেরেখে তার সামনেই স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হলো। এর পরপরই বেগমগঞ্জের এক নারীকে উলঙ্গ করে নির্যাতনের ভিডিও প্রচার। উভয় ঘটনার রেশ না কাটতেই সিলেটে আইন-শৃঙ্খলার রক্ষক দ্বারা এক যুবককে পিটিয়ে নির্মমহত্যা সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। এমনই ঘটনা ঘটেই চলছে দেশজুড়ে। এসবে দেশজুড়ে ঘৃণা, ক্ষোভ, নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বিধান হলো। সমস্যার সমাধান কি হল?
বাস্তবতা ভিন্নরকম। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মামলা গ্রহণে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবজনিত প্রতিবন্ধকতা, মামলা গৃহিত হলেও এর দীর্ঘসূত্রীতা, দীর্ঘসূত্রীতার সুযোগে ও আইনের ফাঁক-ফোকড়ে জামিন নিয়ে আসামির অবাধে বিচরন এবং বাদী বা সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনে মামলাকে প্রভাবিতকরণ ইত্যাদি সবকিছু গুলিয়ে ফেলে। এতে আসামিরা পুরনো অভ্যাসে ফিরে যাচ্ছে। সে মনে করছে, তার এই মামলায় কখনো কিছুই হবেনা, হলেও উচ্চ আদালতে মাফ পেয়ে যাবে। অন্যদিকে, ধর্ষিতা বিবাহিত হলে সংসার হারাচ্ছে, অবিবাহিত হলে আর বিয়ে হচ্ছে না বা দুর্বিষহ সামাজিক ও পারিবারিক জীবন কাটাচ্ছে। সমাজে সে অছুত জীবে পরিগণিত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষিতা পতিতা বা অনৈতিক কোনো জীবনের আশ্রয় নিচ্ছে। কখনো দীর্ঘ জীবন ঐ ধর্ষিতার পক্ষে মামলা চালিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি আর থাকে না। এভাবেই দীর্ঘসূত্রতার বিচার একসময় ধর্ষিতার জন্য প্রহসনে বা আর এক যন্ত্রণায় পরিণত হয়। এখন মামলার দীর্ঘসূত্রতার বিষয়েও ১৮০ দিনে মামলা শেষ করার আইন হয়েছে। এটিকে সাধুবাদ জানাই। তবে বাস্তবে ১৮০ দিনে মামলা শেষ হবেতো? অতীত অভিজ্ঞতায় এমন প্রশ্ন মনে জাগে।
এক্ষেত্রে মনে করি, রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলোকে ধর্ষকের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাববিস্তাররোধে কার্যকর কিছু করা অতীব প্রয়োজন। কেবল আইনে নয়; বাস্তবে ধর্ষণ মামলার আসামি গ্রেফতার, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল, নিম্ন আদালত- উচ্চ আদালতের বিচারকাজ ও রায় কার্যকর একটানা এবং দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অপরিহার্য। দন্ড মৃত্যু হোক বা যাবজ্জীবন হোক। নৃশংস হত্যাকান্ড রোধেও তা প্রযোজ্য। মামলা চলাকালে আসামির জামিন বন্ধ রাখাও জরুরি। এতে করে, নির্যাতনকারী, ধর্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতা, অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে, ধর্ষিতাও তার জীবন সংগ্রামে মানসিক শক্তি পাবে।

লেখক : শিক্ষক