ধর্ম নয় ধর্মান্ধতার বিপক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

28

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন

ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠিত হলেও, ধর্মের এই বন্ধন পুঁজিবাদী লুটেরা শ্রেণির রাষ্ট্র পাকিস্তানের দুই অঞ্চলকে দীর্ঘদিন একত্রে বেঁধে রাখতে পারেনি। এই দুই অংশের মধ্যে ধর্মের এক অভিন্ন মোহ থাকলেও, সেই মোহ একদা মরীচিকার রূপ ধারন করে। বাঙ্গালীদের মোহ ভঙ্গ হতে বেশি দেরি হয়নি। দ্রোহের আগুনে পুড়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এটা কোন ধর্ম যুদ্ধ ছিল না। ছিল ধর্মের নামে অধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সাবলীল ও দৃঢ় কন্ঠে তাঁর ভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ সাম্প্রদায়িক নীতিকে গ্রহণ না করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা দুটি অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত করে বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হয়। কিন্তু পঁচাত্তরের পনের আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার মাধ্যমে সংবিধানের মূলনীতি গুলি ধ্বংস করা হয়। পঁচাত্তর পরবর্তি সরকার গুলো এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। অনেকেই এই প্রশ্নটি নানান ভাবে করে থাকেন- ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বাস্তবে কতটা অসা¤প্রদায়িকতার পরিচয় দিচ্ছে? বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে গঠনতন্ত্র আছে, তার মূলনীতি অংশে বলা আছে; বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হইবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।’ কিন্তু এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কি তার এই ঘোষিত মূলনীতি থেকে সরে এসেছে? কিংবা ঘোষণাপত্রে যে, অসা¤প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে আওয়ামী লীগ কি তার নৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে? এসব প্রশ্ন তখনি সামনে এসে যায় যখন, বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক কিছু উগ্রপন্থী রাজনৈতিক দলের প্রতি নমনীয়তা, বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান, সভা-জমায়েতে স্থানীয় আওয়ামী নেতৃবৃন্দের পৃষ্ঠপোষকতা ও উপস্থিতি কিংবা তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয়। একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার; আর সেটা হল, সরকার দেশের সমগ্র জনগণের। নানান জাত, ধর্ম, বর্ণের মানুষকে সাথে নিয়েই সরকারকে চলতে হয়। এতে পক্ষপাতদুষ্টতার কোন সুযোগ নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিকদল গুলোর সাথে সরকারের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ অস্বীকার করা যায় না। দল আর সরকার কখনোই এক নয়। নির্বিঘেœ রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার ভিন্ন মত ও দলের সাথে আলোচনা বা সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতেই পারে। এইটা আওয়ামী লীগ সরকারের ইতিবাচক রাজনীতির একটা অংশ মাত্র। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একেবারেই তার আদর্শ ও মূলনীতি থেকে চুল পরিমান সরে আসেনি। একদা অপপ্রচার চালানো হত; আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশে মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হবে। আযানের পরিবর্তে উলুধ্বনি দেয়া হবে। গ্রামে-গঞ্জে, চায়ের দোকানে, ওয়াজ মাহফিলে এসব মিথ্যাচার করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধোঁকা দিত স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। কিন্তু আজকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ইসলাম সহ সকল ধর্ম-মতের নিজ নিজ বিকাশ হচ্ছে সেটা প্রমাণিত। মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ‘৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের ৫০টি মসজিদ ইতিমধ্যেই উদ্বোধন করেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এখানে একটি ঘটনা সকলের জানা দরকার আর সেটা হল; মসজিদ তৈরির প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করার কথা ছিল সৌদি সরকারের। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাদের টাকার জন্যে বসেও থাকেননি। তাঁর ভাবনায় ছিল, ‘এটা তো আল্লাহর ঘরের কাজ, পরে কেউ শরিক হতে চাইলে হবে, তাতে বাধা নেই। কিন্তু মসজিদের কাজ, আমরা তো ফেলে রাখতে পারি না।’ পদ্মা সেতুর পর নিজস্ব অর্থায়নে এইটাই দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। একসঙ্গে এতগুলো উন্নত মানের মসজিদ নির্মাণ বিশ্বের আর কোনো দেশে সম্ভব হয়নি। এসব মসজিদে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যথাযথ পর্দা মেনে মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারবেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। লাইব্রেরি, গবেষণা, প্রশিক্ষণ, দাওয়াতি কার্যক্রমসহ বহুমুখী কাজের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে এসব মসজিদ, যা মফস্বল থেকে ঢাকা পর্যন্ত ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের একটি চেইন হিসেবে কাজ করবে। ইসলামের ইতিহাসেও কোন শাসক কতৃক এতগুলো মসজিদ ও ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র কোথাও নির্মান হয়নি। সরকারের এই এক অনন্য রেকর্ড! তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া ও গনমানুষের মুক্তির জন্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা দলটি সম্পর্কে জনগনের একাংশের মনে দলের আদর্শ ও মূলনীতি সম্পর্কে যে ভুল ধারনাটি জেঁকে বসে আছে, সেই ভুল ধারনাটুকু দল এখনো দূরীভূত পারেনি। এদেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দেয়া দলটিকে এখনো ধর্মহীন ও নাস্তিক বলে গালিগালাজ শুনতে হয়। এর দায় দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ কোন ভাবেই এড়াতে পারেন না। কারন প্রান্তিক জনগনের একটা বৃহৎ অংশকে তারা এখনো বুঝাতে সক্ষম হয়নি যে, আওয়ামী লীগ ধর্মহীনতার কথা কখনো বলেনি। বলছে, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। অর্থাৎ যার যার ধর্ম, তার তার। এদেশের মানুষ বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে প্রায় সকলেই ধর্মপ্রাণ। ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এ দেশে রাজনীতি করা, জনসমর্থন লাভ কিংবা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে কথা হল; ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে ঢাল হিসেবে যদি কেউ ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে, সেখানে ঘোর আপত্তি থাকা বাঞ্চনীয়। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের ধ্রুপদী উদাহরণ অহরহ। ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি ছিল চমৎকার। তাঁর গণচীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ যদি সত্যিকারভাবে ধর্মভাব নিয়ে চলতো তাহলে আর মানুষে মানুষে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এইভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম হতো না। কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মের অর্থ যার যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে চালাতে চেষ্টা করেছে। সেই জন্য একই ধর্মের মধ্যে নানা মতের সৃষ্টি হয়েছে। ধরুন রসূলে করিম (দ.) ইসলাম ধর্মকে যেভাবে রূপ দিয়েছিলেন সেইভাবে যদি ধর্ম চলতো তাহা হলে আজ আর মানুষে মানুষে এ বিরোধ হতো না। কিন্তু সেই ইসলাম ধর্মের মধ্যে কত বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সুন্নি, শিয়া, কাদিয়ানি, ইসমাইলি, আগাখানি, আবার মোহম্মদি, ওহাবি, কত রকমের বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে এই ধর্মের মধ্যে। এর অর্থ কী? আমরা দেখতে পেয়েছি শুধু হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরাই একে অন্যের সঙ্গে দাঙ্গাহাঙ্গামা করে নাই। শিয়া সুন্নি দাঙ্গার কথা আপনারা জানেন, হাজার হাজার মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করেছে। আপনারা এও জানেন, কাদিয়ানি-শিয়া-সুন্নিদের সাথে পাঞ্জাবে যে হত্যাকান্ড হয়ে গেছে তার নজির বোধ হয় ইতিহাসে বিরল।’ (আমার দেখা নয়াচীন: ১০৮-১০৯)।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসা¤প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার তিনি নিজে ও দলের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার করে বলেছেন। তাঁর কয়েকটি ভাষণে লক্ষ্য করলে দেখা যায়- ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন প্রাক্কালে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমার সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাস সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসুলে করীম (সা.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বার বার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের কথা ভাবতে পারেন তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফারস্থা করে তোলার কাজে।’ ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম, আমি বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও মেরে ফেল। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। মুসলমান একবার মরে, বারবার মরে না।’
বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা নয় এবং মারাত্মক ধর্মবিদ্বেষ বা খোদাদ্রোহী কোন মতবাদ নয়। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীরা যেমন যেকোন ধর্মের অনুসারী হতে পারেন, ঠিক তেমনিভাবে অন্য ধর্মের প্রতিও তারা যতেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতার অপব্যাখ্যা করে এ মতবাদকে ধর্মবান্ধব নয় বলে আখ্যা দেয়ার অপপ্রয়াস চালানো হয় মাত্র। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বাংলাদেশ অনেক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তিনি কেমন বাংলাদেশ চান, বঙ্গবন্ধু সে কথা পরিষ্কার করে বলেছিলেন। তাই আমরা খুব সহজেই ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে তাঁর অবস্থানটা বুঝে নিতে পারি। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন সেটি ধর্মহীনতা নয়, বরং ধর্মান্ধতা মুক্ত বাংলাদেশ।

লেখক: কলামিস্ট