ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু শিক্ষার্থী নির্যাতন নৈতিকতা ও শুদ্ধাচারি হওয়ার পথ কোথায়?

45

ধর্মপ্রাণ বাঙালিরা তাদের সন্তানকে শৈশব থেকে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে থাকেন ধর্মীয় শিক্ষা ও দীক্ষা দিয়ে শুদ্ধাচারি ও নৈতিক আদর্শসম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে। সম্প্রতি দেশে ব্যাপকহারে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় বেড়ে যাওয়ার ফলে সকল পক্ষ একবাক্যেই বলছেন আমাদের পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অমনোযোগিতার কারণে এসব ঘটছে। একথা একেবারে অবাস্তব না হলেও সমকালিন নৈতিক ও শুদ্ধাচারি হওয়ার কথিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে (বেশিরভাগ কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রিত) বলৎকারসহ শিশু নির্যাতন যে চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে অভিভাবকসহ প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। যা সংখ্যাগরীষ্ঠ মুসলিম দেশে কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
আমরা লক্ষ্য করছি, শিশুর অধিকার সুরক্ষায় যথেষ্ট আইন থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ মানুষই জানে না, শিশুদের ওপর নির্যাতন করা হলে শাস্তির বিধান রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তিকে অভিভাবক-শিক্ষক সবাই সাধারণ ঘটনা হিসেবেই ধরে নেন। শিক্ষকদের এ ধরনের আচরণ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটার খবর গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত আসছে। বিশেষ করে শহরে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় যত্রতত্র গড়ে উঠা মাদ্রাসাগুলোতে শিশু নির্যাতনের খবর আমরা প্রায়ই দেখছি। সর্বশেষ চট্টগ্রামের হাটহাজারী পৌরসভায় অবস্থিত আল মারকাযুল কুরআন ইসলামিক একাডেমি নামের মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষার্থী ৮ বছর বয়সি এক শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জানা গেছে, ওই ছাত্রকে জন্মদিনে গত মঙ্গলবার দেখতে এসেছিলেন তার মা। বিদায়ের সময় শিশুটি মায়ের দিকে ছুটে যায়। এ ঘটনাকে অপরাধ ধরে নিয়ে তাকে মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া প্রথমে ঘাড় ধরে মাদ্রাসার ভেতর নিয়ে যান। তারপর শিশুটির পা ধরে সারা শরীরে বেত দিয়ে বেদম প্রহার করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশু নির্যাতনের এ ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ার পর অভিযান চালিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেন এবং শিক্ষক ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। গত বছর ময়মনসিংহের ভালুকায় জামিরদিয়া মাদ্রাসায় ১০ বছর বয়সি এক শিশুর পড়া মুখস্থ না হওয়ায় শিক্ষক আমিনুল ইসলাম লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শিশুটির পাঁজরের একটি হাড় ও একটি পা ভেঙে দেন। নির্যাতনে আহত শিশুটিকে এরপর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। পরিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করলে ৪ মার্চ সেখানেই মারা যায় শিশুটি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ৬৩.২৪ শতাংশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ২০১০ সালে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়ার নামে নির্যাতনকে সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করে। শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন বন্ধে আইন পাসের পরও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। সরকার আইন পাস করলেও শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ না নেয়ায় আইনের ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সময় এ নির্যাতন শারীরিক ও মানসিক পর্যায়ে হয়ে থাকে, যা মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। অথচ এ ব্যাপারে শিক্ষক বা অভিভাবকরা তেমন সচেতন নন। শাস্তি কখনোই শিক্ষার্থীর চরিত্র বা আচরণে পরিবর্তন ঘটায় না। এসবের পাশাপাশি আরো একটি বড় কারণ হচ্ছে ‘শিশু মনোবিজ্ঞান’ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের, বিশেষ করে শিক্ষক, প্রশিক্ষক ও অভিভাবকদের তেমন কোনো ধারণা নেই। তাই তারা মনে করেন শাস্তি দেয়াই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি থেকে সুরক্ষার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট সরকারি নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন। আমরা চাই, সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নির্যাতন বন্ধ হোক, সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন সবার আগে জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে সরকারের জারি করা পরিপত্রের বাস্তবায়ন যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং আইন লঙ্ঘনকারী শিক্ষকদের বিচারের আওতায়ও আনতে হবে।