ধরা পড়ল পাশবিকতার ‘লক্ষণ’

73

নিজস্ব প্রতিবেদক

নগরীর জামালখান সিকদার হোটেলের পাশে ব্রিজ গলিতে সাত বছর বয়সী শিশুকন্যা মারজানা হক বর্ষা হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ। পাড়ার মুদি দোকান শ্যামল স্টোরের কর্মচারি লক্ষণ দাশ (৩০) একশ টাকা দেয়ার লোভ দেখিয়ে শিশু বর্ষাকে গলির একেএম জামালউদ্দিনের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকা গুদামে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে পাশের বড় নালায় ফেলে দেয়। লাশ উদ্ধারের নয় ঘণ্টার মধ্যেই লাশভর্তি ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) সিলযুক্ত বস্তার সূত্র ধরে সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টায় ব্রিজ গলির গুদাম থেকে পাশবিক হত্যাকান্ডে জড়িত আসামি লক্ষণ দাশকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার বিকালে শিশু বর্ষাকে ধর্ষণের পর হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত লক্ষণ দাশকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালতে হাজির করা হয়। বিকাল চারটা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় বসে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি লক্ষণ দাশ। জবানবন্দি রেকর্ড করার পর আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আসামি লক্ষণ লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর পদুয়া গ্রামের ফেলোরাম দাশের ছেলে। সিকদার হোটেলের পাশের ‘গোপাল মুহুরী গলি’ নামে পরিচিতি পাওয়া ব্রিজ গলিতে শ্যামল স্টোরের পেছনে গুদামে তিনি থাকতেন।
রহস্য উন্মোচনের সূত্র মিলেছে লাশভর্তি টিসিবির বস্তায় : বর্বরোচিত এই হত্যাকান্ডের আসামি লক্ষণ দাশকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল শুক্রবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পুলিশ। এতে হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন ও আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিস্তারিত জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। এসময় নগর পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার মুজাহিদুল ইসলাম জানান, নালা থেকে বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধারের পর বস্তাটি পরীক্ষা করে পুলিশ দেখতে পায়, উপরে সাদা এবং ভেতরে টিসিবি’র সিল রয়েছে। এরপর টিসিবির সিলযুক্ত বস্তার সূত্র ধরেই পুলিশ তদন্ত কার্যক্রম এগোতে থাকে। জামালখানের ব্রিজ গলিসহ আশপাশের এলাকার সব সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। পুলিশের একটি দল ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনায় নিয়োজিত হয়। আরেকটি দল ঘটনাস্থলের আশপাশের সকল মুদির দোকান, রেস্তোরাঁ ও গুদামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্যের বস্তাগুলো যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠানের বস্তা পরীক্ষার পর শ্যামল স্টোরের গুদামে ঢুকে দেখা যায়- উপরে সাদা এবং ভেতরে টিসিবির সিলযুক্ত একটি বস্তা। লাশভর্তি বস্তাটিও দেখতে হুবহু একইরকম ছিল। আবার লাশটিও পাওয়া গেছে শ্যামল স্টোরের পেছনে একেবারে গুদামের সাথে লাগোয়া বড় নালায়। তখনই পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, শ্যামল স্টোরের কেউই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্ত : ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পুলিশ দেখতে পায়, গত ২৪ অক্টোবর অর্থাৎ মারজানা হক বর্ষা নিখোঁজ হওয়ার দিন বিকেল ৪টা ৩৯ মিনিটে গুদামের ফটক দিয়ে প্রথমে আঙিনায় ঢোকেন আসামি লক্ষণ দাশ। এরপর শিশু বর্ষা একবার দৌড়ে গুদামের ফটক দিয়ে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসে। তখন আঙিনায় দাঁড়ানো ছিলেন আসামি লক্ষণ। হাতের ইশারায় বর্ষার দিকে তাকে ইঙ্গিত করতে দেখা যায়। এরপর ফটক দিয়ে বেরিয়ে গলিতে আসে শিশু বর্ষা। আসামি লক্ষণ আঙিনা থেকে গুদামের দিকে ঢোকেন। কয়েক সেকেন্ড পর শিশু বর্ষাও আবার দৌড়ে ফটক দিয়ে ঢুকে গুদামের ভেতরের দিকে চলে যায়। আরেকটি সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ শিশু বর্ষাকে ডেকে গুদামের ভেতরে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি লক্ষণ দাশ হিসেবে শনাক্ত হয়।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-দক্ষিণ) নোবেল চাকমা বলেন, ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে চারটায় বর্ষা তার বাসার গলি থেকে বের হয়ে জামালখানের মূল সড়কে আসে। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে গিয়ে সিকদার হোটেলের পাশের একটি দোকান থেকে চিপস কিনে। সেটি খেতে খেতে সে কিছুক্ষণ সমবয়সী কয়েকজনের সঙ্গে খেলাধুলা করে। এরপর ফুটেজে দেখা যায়, বর্ষা শ্যামল স্টোরের গুদামের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। জামালখানে মূল সড়কের পাশে ব্রিজ গলির প্রবেশমুখে শ্যামল স্টোর নামে দোকানটি। এর পেছনেই গুদামঘর। দোকানের ভেতর দিয়েও গুদামে যাওয়া যায়। আবার ব্রিজ গলি দিয়ে গুদামের পেছনদিকে আরেকটি প্রবেশপথ আছে। ৪টা ৪০ মিনিটের পর ভিকটিম বর্ষা আবার গুদামের ভেতরে ঢোকে। সেখানে তাকে ডেকে নেয়া লক্ষণের চেহারা শনাক্ত করা হয়। ঘটনার সঙ্গে লক্ষণের জড়িত থাকার ব্যাপারে পুলিশ যখন নিশ্চিত হয় তখন তিনি দোকানের ভেতরেই ছিলেন। এরপর তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ।

জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতনের পর হত্যার কথা স্বীকার : সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হলেও রাতভর জিজ্ঞাসাবাদে লক্ষণ দাশ ঘটনার সঙ্গে তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি। শুক্রবার ভোরে এডিসি নোবেল চাকমা, এসি মুজাহিদুল ইসলাম এবং কোতোয়ালী থানার ওসি জাহিদুল কবীর তাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। টানা জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে লক্ষণ স্বীকার করে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কোতোয়ালী থানার ওসি জাহিদুল কবীর জানান, গত ২৪ অক্টোবর বিকেলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি হচ্ছিল। জামালখান এলাকা তখন অনেকটা নীরব হয়ে পড়ে। ব্রিজ গলিও ছিল প্রায় জনমানবহীন। লক্ষণের সঙ্গে বর্ষার আগে থেকে কথাবার্তা হতো। মাঝে মাঝে বর্ষাকে চিপস-চকলেট দিত লক্ষণ। বর্ষা যখন বাসা থেকে বের হয় তখন তেমন বৃষ্টি ছিল না। গুদামের পেছনের প্রবেশমুখে বর্ষাকে দেখে তিনি ডেকে ভেতরে নেন। মিনিটখানেক পর বর্ষা বেরিয়ে আসে। এরপর লক্ষণ একশ’ টাকার একটি নোট বের করে বর্ষাকে দেখিয়ে ডাকলে সে ভেতরে যায়। ভেতরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণ গুদামের দরজা বন্ধ করে দেন। সেখানে লক্ষণের ঘুমানোর একটি খাট আছে। সেই খাটে ফেলে যতটা সম্ভব হাত-মুখ চেপে ধরে বর্ষাকে ধর্ষণ করে। এরপরও বর্ষার গোঙানি ঝড়ো হাওয়ার কারণে বাইরে তেমন আসেনি। ধর্ষণের একপর্যায়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ দেখে লক্ষণ ভয় পেয়ে যায়। তখন শিশুটি চিৎকার করে কান্না করতে থাকলে লক্ষণ সজোরে বর্ষার গলা ও মুখ চেপে ধরে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শিশুটি নিস্তেজ হয়ে যায় এবং লক্ষণ বুঝতে পারে সে মারা গেছে।
মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘পাষন্ড’ লক্ষণ গুদামে থাকা টিসিবির চিনির একটি খালি বস্তা উল্টে সেখানে উলঙ্গ অবস্থায় লাশ ঢুকিয়ে নেয়। বস্তায় ভরে লাশ ফেলে দেয় গুদামের সঙ্গে লাগোয়া বড় নালায়। লাশ ফেলে দেয়ার পর দেখতে পায়, বর্ষার পরিহিত পোশাকগুলো রয়ে গেছে। সেগুলো পেঁয়াজের খোসাভর্তি আরেকটি বস্তায় ভরে নালায় ফেলে দেয়। এরপর গুদামের ফ্লোরে বর্ষার স্যান্ডেলগুলো পড়ে থাকতে দেখে সেগুলোও কুড়িয়ে নিয়ে নালায় ফেলে দেয়।
উল্লেখ্য, গত ২৭ অক্টোবর বিকালে নগরীর জামালখান সিকদার হোটেলের পাশে ব্রিজ গলির বড় নালা থেকে মারজান হক বর্ষার (৭) লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ২৪ অক্টোবর বিকালে ওই এলাকায় বাসা থেকে বিস্কুট কিনতে বের হওয়ার পর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। সে নগরীর কুসুমকুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তার বাবা আব্দুল হক মারা গেছেন। মা ঝর্ণা বেগম ও সৎ বাবা মোহাম্মদ ইউছুপের সঙ্গে ব্রিজ গলির বাসায় থাকতো। তার আরও দুই বোন আছে। লাশ উদ্ধারের পর তার মা বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় হত্যা মামলা করেছেন।