ধনী-গরীব রোজাদারের ইফতার একসারিতে

27

এম এ হোসাইন

ক্লান্ত পথিক, অবসন্ন দিনমজুর, এদ্বার-ওদ্বারে ঘুরে পরিশ্রান্ত শ্রমিক, ভিক্ষুকসহ নিম্নবিত্তের মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী-ধনী সবাই বসেছেন একই কাতারে। দুই হাজারের অধিক এমন লোকের বৃহৎ ইফতারের জমায়েত নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে। ২০০৭ সাল থেকে প্রতি রমজানে নিয়মিত এমন আয়োজন হয়ে আসছে মসজিদটিতে। মনের তৃপ্তি আর সওয়াবের আশায় সবাই শরীক হয়েছেন এ ইফতার আয়োজনে। আবার অনেক দূর থেকেও ইফতারে যোগ দিতে আসেন অনেকে, তারা ফিরেন তারাবিহ সালাত আদায় করে।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব সাইয়্যদ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল-মাদানী বলেন, মক্কা-মদিনার আদলে এখানে ইফতার আয়োজন করা হয়। গরীব-অসহায়রা যেমন একই কাতারে বসে ইফতার করেন, তেমনি অনেক ধনী লোকজনও এখানে ইফতারে শরীক হন। আমি নিজেও এখানে ইফতার করছি। এখানে ধনী-গরীব কোনো ভেদাভেদ নেই। সওয়াবের আশায় সবাই একসাথে বসে ইফতার করেন।
মনের তৃপ্তি আর হাজারো লোকের সাথে একসাথে ইফতার আর নামাজ আদায় করার ফজিলতের কারণেই মূলত দূর থেকে মুসল্লিরা ছুটে আসেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে। আছরের নামাজের পর থেকে ইফতারের প্রস্তুতি শুরু হয়। সারিবদ্ধ হয়ে মসজিদের কাতারে বসে পড়েন সবাই। বাসন ও থালায় করে পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত করা হয় ইফতারি। প্রথম রমজানের দিনে আড়াই হাজার রোজাদারের ইফতারির আয়োজন করা হয়। আসরের নামাজের পর থেকে শুরু হয় ইফতারের ফজিলত নিয়ে আলোচনা।
রাজাদাররা আলোচনা শুনতে সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন বারেন্দায়। লম্বালম্বি মুখোমুখি সারি। নানা বয়সের এবং শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন এতে। ধনী-গরীব কোনো ভেদাভেদ নেই। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসলে একে একে ইফতারির বাসনগুলো রোজদারদের সামনে দিয়ে আসেন স্বেচ্ছাসেবকরা। সবাই পাশাপাশি বসে ইফতারে শরীক হন। সম্পূর্ণ মক্কা-মদিনার আদলে এ ইফতার।
মসজিদের খতিব সাইয়্যদ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল-মাদানীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং মসজিদের মুসল্লি পরিষদের সার্বিক সহযোগিতায় ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিত এ ইফতারের আয়োজন হয়ে আসছে।
শাহী জামে মসজিদের খতিবের সহকারী হাছান মুরাদ বলেন, খতিব হুজুরের তত্ত¡াবধানে ইফতারির আয়োজন করা হয়। সওয়াবের নিয়তে রোজাদারদের সাথে ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও ইফতারে শরিক হন। প্রথম কয়েকদিন দুই থেকে আড়াই হাজার, এরপর থেকে চার হাজার রোজাদারের জন্য ইফতার আয়োজন করা হয়। সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয় ইফতারি। টাটকা ও স্বাস্থ্য সম্মত ইফতারি যাতে সবাই খেতে পারেন, সেই চেষ্টা করা হয়। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এ ইফতারের আয়োজন করা হয়। এখানে যারা সহযোগিতা করেন, তারা কেউ নামের জন্য করেন না।
বৃহৎ ইফতার আয়োজনের চিত্রটা সন্ধ্যায় দেখা গেলেও এর কার্যক্রম শুরু হয় সেহেরীর পর থেকেই। সেহেরী শেষ করে বাবুর্চিরা নেমে পড়েন মসলাপাতি নিয়ে। প্রস্তুত করা হয় আনুষাঙ্গিক অন্যান্য জিনিসও। সকাল হলেই চুলায় দেওয়া হয় আগুন। ছোলা, পেঁয়াজু, জিলাপি, বেগুনি, শরবতসহ বেশ কয়েকটি আইটেম বানানোর এ কাজ চলে বিকেল চারটা পর্যন্ত। এরপর থালা ও বাসনে করে সে ইফতারি পরিবেশন করা হয় রোজদারদের।
প্রতি রমজানে তিন থেকে পাঁচ হাজার রোজাদারের এমন আয়োজন পুরোটা সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করা হয়। স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকেন বাবুর্চিরা। কয়েকজন বিত্তবান ব্যক্তি নিয়মিত ইফতার আয়োজনে সহযোগিতা দিয়ে আসলেও তারা কেউ-ই চান না, নিজেদের পরিচয় জানাতে। এছাড়া অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন এখানে। কিন্তু তাও পরিচয় গোপন রেখে।
ইফতারের সময় সারিবদ্ধ হওয়া রোজাদাররা যেন একাকার হয়ে পড়েন। একসাথে এতো মানুষের ইফতার হলেও কোনো ধরনের কোলাহল নেই। দোয়া-দরুদ আর মোনাজাতের পর নিরবতার মধ্যেই শেষ হয় ইফতার আয়োজন।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে রমজানের প্রথম ইফতারে অংশ নেয়া মোহাম্মদ আজম বলেন, একসাথে এতো মানুষের সাথে বসে ইফতার করার সুযোগ সব সময় আসে না। বেশি মানুষের সাথে ইফতার করা ও সালাত আদায় করার ফজিলত বেশি। সেজন্য এখানে ইফতারে অংশ নিলাম। এখানকার ব্যবস্থাপনাও দারুন। বাড়িতে যে ধরনের ইফতার করতাম, এখানে তার চেয়েও বেশি ইফতার আয়োজন ছিল। এতো সুন্দর কার্যক্রম দেখে মুগ্ধ হই।
১৯৯৬ সালের দিকে প্রথম মক্কা-মদিনার আদলে এ ধরনের ইফতারের রেওয়াজ চালু করার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা এবং আলাপ-আলোচনা করতে থাকেন মসজিদের খতিব। ২০০৭ সাল থেকে চালু হয় ভিন্নধর্মী এ আয়োজন। প্রতিবছর চার-পাঁচজন বিত্তবান নিয়মিত সহযোগিতা দিয়ে আসছেন বিশাল এ কর্মযজ্ঞে। তবে তারা চান না নিজেদের পরিচয় জানাতে। এছাড়া অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন এ ইফতার আয়োজনে। কিন্তু তা পরিচয় গোপন রেখে।
মসজিদের একপাশের রান্নাঘরে বড় বড় পাতিলে রান্না পাকানো হয়। মসজিদের নিজস্ব ডিপ টিউবঅয়েল থেকে পানি সরবরাহ করা হয়। ইফতার আয়োজনে অংশ নেওয়া রোজদাররা আসরের নামাজের পর থেকে মসজিদে অবস্থান শুরু করেন। আর মসজিদে প্রতিদিন আসরের নামাজের পর শুরু হয় রমজানের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা। চলে ইফতারের আগ পর্যন্ত। এরপর মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় আলোচনা।