দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ : দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া চট্টগ্রামে

231

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে। চট্টগ্রাম এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শহর। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধ বিমান উড়ছে শকুনের ঝাঁকের মতো, বিমানের প্রচন্ড গর্জনে কানে তালা লাগার অবস্থা। বিমানগুলো কখনো উপড়ে উঠছে – বিমান বিধ্বংসী কামানের নাগালের বাইরে উঠে যাচ্ছে, কখনো ছোঁ-মারার মতো নিচে নেমে আসছে। জাপানী বিমানগুলো নিচে মেনে সমুদ্রের উপর দিয়ে এসে অতর্কিতে হানার মতো দৃশ্যগোচর হচ্ছে, দেখা যাবার সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হচ্ছে বোমা ফাঁটার। কালো লম্বাটে বোমারু বিমান থেকে বোমা ফেলে চোখের পলকে পালিয়ে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ক্যম্প থেকে সাইরেন বাজানো হচ্ছে মানুষকে সতর্ক করার জন্য, লোকজন ছোটছুটি করে ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিচ্ছে, কেউ নিকটবর্তী পাকা বাড়ির মধ্যে। ব্রিটিশ বিমান বিধ্বংসী কামানগুলো গর্জে উঠছে, কিন্তু লক্ষ্যভেদ দুরের কথা কিন্তু তার আগেই জাপানী বিমানগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিপদ মুক্তির সাইরেন বেজে উঠতে লোকজন আবার বেরিয়ে এলো ট্রেঞ্চ থেকে। ব্রিটিশ ফৌজের অপদার্থতা দেখে তখন লোকের হাসির খোরাক ছিল, লোক বলত জাপানী বিমান আক্রমণ করে চলে যাবার পরেই সাইরেন বাজে। ব্রিটিশের সামরিক শক্তির উপর মানুষের কোনো আস্থা ছিল না। প্রাথমিক অভিজ্ঞতায় আস্থা থাকার কথাও নয়। তারপরের দৃশ্য নিরাপত্তার আশায় দলে দলে নর-নারী শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে শুরু করে। যাদের যাবার উপায় নেই তারাই কেবল আছেন। আর আছেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও সমর্থকেরা। তাঁরা মানুষকে নির্ভয় করার জন্য শহরে রয়েছেন। কমিউনিস্টরা আত্মগোপন করে কাজ করছেন। কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতরক্ষা আইনে পরোয়ানা জারি আছে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাঁরা বিপদজনক লোক।
বাংলার সীমান্ত জেলা চট্টগ্রামকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেছিল ব্রিটিশ সরকার। চট্টগ্রাম যুদ্ধঘাঁটি হওয়ায় এখান থেকে বোমারু বিমান যাত্রা করত বার্মার দিকে। এখান থেকে ফ্রন্টে অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ করা হত। সুতরাং শহরে ও গ্রামে সৈন্য শিবির ছিল, পথে-ঘাটে নানা দেশের সৈন্যদের দেখা যেত। আর্মার্ডকার, ট্রাঙ্ক দেখা যেত। শহরে খাঁকি পোশাকের লোকই বেশি চোখে পড়ত। ব্রিটিশ, নিউজিল্যান্ড, আফ্রিকান, ভারতীয় দেশীয় রাজ্যের বাহিনী, গোর্খা, জাঠ ইত্যাদি সৈন্যদের সমাবেশ হয়েছিল। নানা দেশের এত সৈন্যের ভিড়ে শহরে এবং সৈন্যশিবিরের কাছাকাছি গ্রামের নারীদের নিরাপত্তা ছিল না। সুতরাং নারী ও বালক-বালিকাদের গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। না পাঠিয়ে উপায় ছিল না। কারণ ওদের হাতে বন্দুক, রিভলবার আছে। কোনো গৃহস্তের বাড়িতে হানা দিলে নারীর ইজ্জত রক্ষা করার শক্তি কোথায়। সৈন্যরা বিশেষ করে বিদেশী সৈন্যরা খোলাখুলি জিজ্ঞাসা করত মেয়ে পাওয়া যাবে কোথায়। শহরের বেশ্যাপল্লীতে রাত-দিনের তফাৎ ছিল না। খাসি পোষাকের লোকদের আনাগোনা। ওরা এদেশে বিদেশে এবং এই বিদেশী ব্রিটিশ উপনিবেশ, সুতরাং লোকলজ্জার ভয় নাই। যেখানে যুদ্ধ সেখানে নৈতিক অবনতি। যুদ্ধের সঙ্গে নৈতিক অবনতির সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি। যুদ্ধ বলতে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কথা বলছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সৈন্যরা এসেছে, যাদের কোনো আদর্শ নেই, দেশপ্রেম নেই, টাকার জন্য সৈনিকবৃত্তি গ্রহণ করেছে। নারী সন্ধানী সৈনিকদের মুখে নতুন নতুন কথা শোনা গেল, যার অর্থ এ দেশবাসীর জানা ছিল না। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল, তখন অঙ্গভঙ্গি করে বুঝাত। যেমন ওরা প্রশ্ন করত- ‘ফাকিং গার্ল’ কোথায় পাওয়া যায়? পথচারীরা অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। কী লজ্জা! কিন্তু ওদের কাছে লজ্জা ছিল না। যুদ্ধ মানুষকে জানোয়ার করে তোলে। ঠিকাদাররা সেনা অফিসারদের নারী যোগান দিত তাড়াতাড়ি বিল পাশ করাবার জন্য। দরিদ্র মেয়েদের ফঁসলিয়ে নিয়ে আসত। তখন জিনিষপত্রের দামবাড়তে শুরু করেছে, ক্ষুধার তাড়নায় অনেক মেয়ে এই ফাঁদে পা ফেলতে বাধ্য হত। যৌন পশুত্বের আরেক রূপ ছিল সমকামিতা, বালকদের খুঁজত, ওদের ভাষায় ‘জিকজ্যাক বয়’। অপরাধ জগতের এরকম অনেক ভাষা যুদ্ধের সময় এদেশে এসেছে, নতুন সাঙ্কেতিক শব্দ তৈরীও হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ রাজের যুদ্ধবিমান ব্যবহারের জরুরি প্রয়োজনে ১৯৪১ সালে পতেঙ্গায় জরুরীভাবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর স্থাপন করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে একদিন সকাল বেলা চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে সদ্য নির্মিত পতেঙ্গা বিমান বন্দরে জাপানী বিমান উপর্যুপরি বোমা ফেলে। ইতিপূর্বে জাপানী বিমান বারে বারে টহল দিয়েছে।
১৯৪২ সালের ১০ ই মার্চ জাপান বার্মা (মিয়ানমার) দখল করে। এতে আতঙ্ক আরো বৃদ্ধি পায়। বার্মা পতনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ভারত সরকার পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করেছিল। নৌকা চলাচল বন্ধ করে দিল। নৌকা গুলো খাল ও নদীর পাড়ে তোলে অকেজো করে রাখল, মাঝিরা বেকার হয়ে গেল। নৌকার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মী ও কারিগররা বেকার হল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, শঙ্খ, হালদা নদী ও উপ নদীগুলোতে হাজার হাজার দুই দাঁড়ের বার্মা দেশীয় নৌকা চলত। সবগুলোই চলাচল বন্ধ করে দিল। আরাকান-চট্টগ্রাম, স›দ্বীপ-চট্টগ্রাম যোগাযোগ রক্ষা ও মালামাল বহনকারী বড়ম নৌকা গুলো চলাচল বন্ধ করে দিল। সুতরাং হাজার হাজার কর্মজীবী বেকার হয়ে গেলেন। নদী ও সমুদ্রে জেলেদের মাছ ধরার নৌকা বন্ধ করে দিল। জেলেরাও বেকার হয়ে গেলেন। কর্মকার, কুম্ভকার, তন্তুজীবীদের পেশা বন্ধ হয়ে গেল। দিশেহারা হয়ে এসব পরিবারের পুরুষেরা প্রথমে এবং পরে ঘরের বৌরা মিলিটারির রাস্তা বাঁধার কাজে লাগল। রাস্তা বাঁধার জন্য মিলিটারিরা কৃষি জমি দখল করল। ফলে চাষাও মার খেল। কৃষকেরা বেকার হয়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে চালের আড়তদাররা বাজার থেকে চাল কিনে গুদামজাত করে, সৈন্যবিভাগের ঠিকাদারদের কাছে বেশি দামে বেঁচে মুনাফা করতে লাগল। আরেকদিকে মিলিটারিদের রসদ সরবরাহকারীরা বাজারে নেমে বেশি দামে চাল কিনতে শুরু করে। ফলে বাজার থেকে চাল উধাও হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষায় নতুন দুটি শব্দের সংযোজন ঘটে। মজুতদার, চোরাকারবারী। এই শব্দ দুটি যেন মনুষ্যত্ব হীনতায় এবং লালসার প্রতিশব্দ।
১৯৪২ সালের ৮ মে সকালবেলা চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে সদ্য নির্মিত পতেঙ্গা বিমান বন্দরে জাপানি বিমান উপর্যুপরি বোমা ফেলে। শুধু বোমা নয় মেশিনগানও সেদিন চার্জ করা হল বিমান থেকে। বোমা ও মেশিনাগানের গুলিতে চট্টগ্রাম বিমান ঘাঁটিতে শ্রমিক নিহত হয়েছিল ১৫০ জন। এই দিন জাপানী জঙ্গী বিমান চট্টগ্রামের আকাশে মুহুর্মুহু হানা দিল। এতে আরও আতঙ্ক বৃদ্ধি পায়। সরকারি প্রশাসন প্রায় ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে যায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি.জেমিসন এতে অসহায় বোধ করেন। তিনি রেল স্টেশনে উপস্থিত হয়ে কর্মচারীদের শহর থেকে চলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।
জাপান বার্মা (মায়ানমার) দখল করে ১৯৪২ সালের ৯ মে। এ সময় বার্মা প্রবাসী ভারতীয়দের উপর অত্যাচার শুরু করে বর্মীরা। ধনরত্ন কেড়ে নেয়াসহ ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ব্রিটিশ সরকার বার্মা ত্যাগ করে পিছু হটে আসে। তখন দলে দলে ভারতীয়রা ভারতের পথে প্রত্যাবর্তন শুরু করে। জাহাজের উপর বোমাবর্ষণের দরুন জাহাজ চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। অনন্যোপায় হয়ে দলে দলে লোকজন হাঁটাপথে, নৌকায় আসতে শুরু করে। সোজা কোন পথ ছিল না, জঙ্গল কেটে পথ করে চট্টগ্রামের দিকে আসতে শুরু করে লক্ষ লক্ষ লোক। পথে অনাহারে মৃত্যু ঘটেছে, পথশ্রমে মৃত্যু হয়েছে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ছেড়ে এসেছে পরিবারের লোকজন, শিশুদের বহন করতে না পেরে বার্মার অধিবাসীদের বাড়িতে রেখে এসেছে অনুনয়-বিনয় করে। এই পরিস্থিতিতে জাপানী বিমান পথ-যাত্রীদের উপর বোমা বর্ষণ করেছে।
জাপানিরা আরাকান দখল করে নেয়ার পর ব্রিটিশরা চট্টগ্রামের হাটহাজারি, চন্দনাইশের দোহাজারি ও চকরিয়ার চিরিঙ্গা প্রভৃতি স্থানে সামরিক বিমানঘাঁটি নির্মাণ করে আরাকান ফ্রন্টে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঐ সময় বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করার জন্য কালুরঘাট রেলওয়ে ব্রীজকে বাস ও ট্রাক চলাচলের উপযোগী করা হয়। জাপানি বোমারু বিমান চট্টগ্রাম শহর, বন্দর ও গ্রামাঞ্চলে ৯ মে পুনরায় বোমা বর্ষণ করে। পরবর্তীতে ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে বোমা বর্ষণ হয়েছিল ২ বার। ২৫ অক্টোবর আবারও বিমান হামলা হল। ৫, ১০, ১৫, ১৬, ২৩ ও ২৭ ডিসেম্বর পর পর বিমান হামলা হল চট্টগ্রামে। ১৯৪৩ সালের ১৭ ও ২৩ জানুয়ারি আবারো চট্টগ্রামে বিমান হামলা হল। ২ ও ২৪ মার্চ পুনরায় চট্টগ্রামে বিমান হামলা হল। ৪ ও ৮ এপ্রিল পুনরায় চট্টগ্রামে বিমান হামলা হল। ২২ এপ্রিল কক্সবাজার বিমান ঘাঁটিতে, ঐ সময় চারটি জাপানী বিমান ধ্বংস হল। ১৯ ও ২২ মে এবং, ২০ অক্টোবর চট্টগ্রামে, ২৫ অক্টোবর কক্সবাজারে বিমান হামলা হল। ১৬ ও ২০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে বিমান হামলা হল। এসব বিমান হামলায় বহু লোক হতাহত হল। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে এই সময় প্রায় ১৫টি জাপানী জঙ্গী বিমান ধ্বংস হল।
জাপানি বিমান ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে পতেঙ্গা বিমান বন্দর তছনছ করে দেয়। সেবার বোমাবর্ষণে ট্রেঞ্চে আশ্রয় নেওয়া চল্লিশ জনের মৃত্যু হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ হয় ১৯৪৩ সালে। উল্লেখ্য যে, ১৯৪১ সালে চালের দাম ছিল মণ প্রতি ৩ টাকা ৮০ পয়সা। সেকালে মণ ও সের দরে জিনিষপত্র বিক্রি হত। ৪০ সেরে এক মণ। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি থেকে দাম চড়তে থাকে। ফেব্র“য়ারিতে ৬ টাকা, মে ৮ টাকা, আগস্ট ১০ টাকা, অক্টোবর ১২ টাকা, ডিসেম্বর ১৮ টাকা। ১৯৪৩ সালের মার্চে ৩৫ টাকা, জুনে ৪০ টাকা, অক্টোবরে ৬০ টাকায় ওঠে। দু’টাকা সের দরে চাল কেনার ক্ষমতা দরিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের প্রশ্নতো উঠেই না, মধ্যবিত্তরাও অসহায় বোধ করতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে সরকার ভিন্ন রাজ্য থেকে সস্তা দরে বাজরা নামক একরকম শস্য আমদানি করল, গম আমদানি করল। গম চট্টগ্রামীদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল না, রুটি করে বা আটা পানিতে গুলে মানুষ তা খেতে আরম্ভ করল। বাজরা গুড়ো করে, অথবা বাজরার খিচুড়ি করে খেতে বাধ্য হল। কিন্তু পেটে সহ্য হল না। অসংখ্য মানুষ মরল পেটের অসুখে। নিু মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে একবেলা খাদ্য গ্রহণ, তাও চাল-গম-বাজরা মিশিয়ে খাওয়া অভ্যাসে পরিণত হল। কামার, কুমার, নৌকার মাঝি, দিনমজুর, মৎস্যজীবী লক্ষ লক্ষ নরনারী যারা ব্রিটিশ সরকারের পোড়ামাটি নীতির জন্য জীবিকা হারিয়েছিল তাদের তো ৮০ টাকা দামে এক সের বা একমুঠো চাল বা বাজরা কেনার ক্ষমতা ছিল না। তারা দলে দলে শহরের দিকে আসতে শুরু করল, সৈন্য ছাউনির দিকে গেল ওদের উচ্ছিষ্ট খাদ্য কুড়োতে। হাতে টিনের পাত্র নিয়ে ঘরে ঘরে ভিক্ষাপ্রার্থী এল। প্রথমে বলেছিল ভাত দাও মা, ভাত কে দেবে? তখন কান্না মিশ্রিত কথা শোনা গেল ফ্যান দাও। ফ্যানও পাওয়া যায় না। দেখা গেল নৌকাঘাটে, রাস্তার ধারে প্রথমে শিশুদের মৃতদেহ, তারপরে নারীদের মৃতদেহ, তারপর কঙ্কালসার পুরুষের মৃতদেহ। এমনও দেখা গেল মৃত মায়ের স্তন চুষছে জীবন্ত শিশু। আকাশে শকুন উড়ছে।
ক্ষুধাকে ঠেকাতে গ্রামের মানুষ জমি বেচল, গরু বেচল, ঘরের জিনিষপত্র বেচল। অবশেষে পুত্র-কন্যা বেচল, শেষ পর্যন্ত স্ত্রী পর্যন্ত বেচল। অন্ন কুড়াতে স্বামী স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সৈন্য ব্যারাকে অন্ন ভিক্ষা করতে গিয়ে ইজ্জত খোয়াল, অবিবাহিত কন্যা বেশ্যায় পরিণত হল। পরিতত্যক্ত বাড়ির বারান্দায়, স্টেশনের আশেপাশে, স্টেশনের প্ল্যাটফরমে এসব বুভুক্ষ নরনারীর ভিড়। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, এরাই গ্রামের কৃষক, কারিগর, মৎস্যজীবী ছিল। ছিন্নবস্ত্র বা নেংটি পড়া, মেয়েরা বেআব্র“, বুকের হাড় বেরিয়ে আছে, চোখ কোঠারাগত, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, উদাস অসহায় দৃষ্টি।
নদীর ধারে, খালের পারে মৃতদেহ ঘিরে শকুন বসেছে। পৌরসভার কর্মীরা মৃতদেহ সরাতে অথবা পোড়াতে, মাটিচাপা দিতে আর পেরে উঠছে না। কখনো রাস্তার ধারে রেখে দিত, কখনো ডাসবিনের ধারে রেখে আসত। মানুষ বড় নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিল। বোধহীন হয়ে পড়েছিল। গ্রামের গরীব পাড়াগুলো একেবারে, বাড়িঘর ভেঙ্গে পড়েছে। ধারে ধীরে এক বছরের মধ্যে দেখা গেল ভিটেতে ঘাস গজিয়ে উঠেছে। এক বছর আগে এখানে মানুষের বসবাস ছিল তা চেনার উপায় নেই।
এই অনাহার পর্বের পরে এক মহামারী দেখা দিল। এক রকম শোথরোগ। যে রোঘ আগে কখনো দেখেনি। ডাক্তাররা এরূপ রোগির কথা জানত না, সুতরাং হাসপাতালে পাঠিয়ে উপযুক্ত ওষুধ পাওয়া গেল না। প্রথমে পা, তারপর সমস্ত শরীর ফুলে ঢোল হয়ে যেত। সারা শরীরে জল। তারপর শরীর ফেটে ফেটে ঘা, ঘা থেকে জল ঝরছে, দুর্ঘন্ধ, কাছে যাবার উপায় নেই। সুতরাং চলার শক্তি নেই, শুয়ে থাকে, এক সময় নি®প্রাণ। ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে চট্টগ্রামের শহর, বন্দর ও গ্রামে আঠারো লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে দুই লক্ষাধিক নরনারীর মৃত্যু হয়। সমগ্র বাংলায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় আট লক্ষ নরনারীর। এই দুর্ভিক্ষ চট্টগ্রামীদের কাছে তেতাল্লিশের রাড নামে পরিচিত। এখানে দ্বিতীয় যুদ্ধকালে বার্মাফ্রন্টের যুদ্ধে নিহত সাত শতাধিক ব্রিটিশ, অস্ট্র্রেলিয়ান, কানাডা, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সৈনিকের মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। সার্সন রোড ও চট্টেশ্বরী রোডের সংযোগস্থলে। তৎমধ্যে ১৭ জন সৈনিকের জাতীয়তা চিহ্নিত করা যায় নি। ১৯৪৬ সালে এলাকাটি ওয়ারসিমেট্রি নামকরণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণ হয়ে থাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চরম দুর্ভিক্ষে সাধারণ মানুষের অসহায় অবস্থাকে কেন্দ্র করে কবিয়াল রমেশ শীল রচিত এই গান-
দেশ জ্বলে যায় দুর্ভিক্ষের আগুনে
এখানে লোক জাগিল না কেনে।
দিনমজুর ঘরজা যারা, গত সন মরেছে তারা
ঘরের ছানি দিব কেমনে।
মরে গিয়েও যারা আছে তারাও মরতে বসেছে
অনাহার আর রোগের পীড়ণে।
দুইবেলা কেহ খায় না, কেহ কারো পানে চায় না
ভিক্ষো পায় না অন্ধ আতুর গনে।
অনাহারে শরীর জীর্ণ মার বুকেতে দুগ্ধ শূন্য
দুগ্ধ পোষ্য মরে দুগ্ধ বিনে।
পূত্র কন্যা বেচে পিতা ছেলের আহার খাচ্ছে মাতা
দয়া নাইকো কাহারো পরাণে।
অন্নবস্ত্রে পেয়ে কষ্ট কত সতীনের সতীত্ব নষ্ট
দারুণ এই উদরের কারণে।