দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

10

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবি, নাট্যকার, গীতিকার। ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে তাঁর জন্ম। পিতা সুকণ্ঠ গায়ক কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের দেওয়ান এবং মাতা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত প্রভুর বংশধর। তাঁর দুই অগ্রজ রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক ভ্রাতৃজায়াও সাহিত্যিক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল হুগলি কলেজ থেকে বিএ এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (১৮৮৪) পাস করেন। পরে কিছুদিন চাকরি করে তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য লন্ডন যান এবং সেখানে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। লন্ডনের সিসিটার কলেজ থেকে তিনি কৃষিবিদ্যায় এফ.আর.এ.এস ডিগ্রি এবং রয়েল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটির এম.আর.এ.সি ও এম.আর.এস.এ উপাধি লাভ করেন। বিলেত থেকে ফিরে তিনি মধ্যপ্রদেশে জরিপ ও রাজস্ব নিরূপণ ট্রেনিং নেন এবং সরকারি ডেপুটির চাকরি পান; পরে তিনি দিনাজপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন।
দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা মানুষ; এজন্য কর্মক্ষেত্রে তিনি অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুটা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসারের দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রজাদের স্বার্থে ছোটলাটের বিরোধিতা করতে কুণ্ঠিত হননি। বিলেত থেকে ফেরার পর প্রায়শ্চিত্ত করার প্রশ্ন উঠলে তিনি তা অস্বীকার করেন এবং এজন্য তাঁকে অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে তাঁর একঘরে (১৮৮৯) নামক পুস্তিকায়।
দ্বিজেন্দ্রলাল ১৯০৫ সালে কলকাতায় ‘পূর্ণিমা মিলন’ নামে একটি সাহিত্যিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি তখনকার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিসেবী বাঙালিদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। এ সময় তিনি ‘ইভনিং ক্লাব’ নামে অপর একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এবং এর মাধ্যমে তিনি প্রথম অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। বিলেতে থাকা অবস্থায় তিনি সেখানকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়-কৌশল ও রঙ্গালয়-ব্যবস্থা নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করেন, যা পরবর্তীকালে নাটক রচনা ও অভিনয়ে তাঁকে গভীরভাবে সহায়তা করে।
দ্বিজেন্দ্রলাল কৈশোরেই কাব্যচর্চা শুরু করেন। ছাত্রজীবনে তাঁর আর্য্যগাথা (১ম ভাগ, ১৮৮২) এবং বিলেতে থাকাকালে খুৎরপং ড়ভ ওহফ (১৮৮৬) কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯০৩ সাল পর্যন্ত তিনি মূলত কাব্যই রচনা করেন এবং এ সময় পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ বারোটি।
দ্বিজেন্দ্রলাল খুব অল্পবয়স থেকেই গান রচনা করতেন এবং নিজেই সুর দিয়ে গাইতেন। বিলেত যাওয়ার আগে মাত্র সতেরো বছর বয়সের মধ্যে লেখা একশো আটটি গান নিয়ে তাঁর প্রথম গীতসংকলন আর্য্যগাথা (প্রথম ভাগ) ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়। কিশোর বয়সে লেখা এ গানগুলিতে প্রকৃতির মনোরম সৌন্দর্য ও লাবণ্য, জগতের শোক-জরাজাত দুঃখাবসন্নতা, ঈশ্বরভক্তি এবং স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পেয়েছে। এ পর্বের একটি গান হলো: ‘গগনভূষণ তুমি জনগণমনোহারী!/ কোথা যাও নিশানাথ, হে নীল নভোবিহারী!।’
দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৮৭ সালে এগারো বছর বয়সের সুরবালা দেবীকে বিবাহ করে সংসারজীবন শুরু করেন। এ সময়কালে দাম্পত্যসুখমগ্ন দ্বিজেন্দ্রলাল রচনা করেন অপূর্ব সব প্রেমের গান, যা ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত আর্য্যগাথা-র দ্বিতীয়ভাগে স্থান পায়। এ পর্বের দুটি গান হলো: ‘ছিল বসি সে কুসুম-কাননে/ আর অমল অরুণ উজল আভা/ ভাসিতেছিল সে আননে।’ এবং ‘আজ যেন রে প্রাণের মতন/ কাহারে বেসেছি ভালো!/ উঠেছে আজ মলয় বাতাস,/ ফুটেছে আজ মধুর আলো।’ প্রথম গানটি কীর্তন ঢঙে রচিত এবং রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল। এ ধরনের গান রচনার মূল প্রেরণা ছিল স্ত্রী-প্রণয়। তাই প্রথম ভাগের গানে যেখানে প্রকৃতিপ্রেম ও দেশপ্রেমের উচ্ছ¡াস দেখা যায়, সেখানে দ্বিতীয়ভাগের গানে দেখা যায় তাঁর প্রণয়োচ্ছ¡াস।
১৮৮৮ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর ভাগলপুর ও মুঙ্গেরে থাকার সময় প্রখ্যাত খেয়ালগায়ক সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের নিকট দ্বিজেন্দ্রলাল সঙ্গীত শিক্ষা করেন। সুরেন্দ্রনাথ খেয়ালগানে টপ্পার চাল মিশিয়ে এক ধরনের চমৎকার গান গাইতেন, যাকে বলা হয় টপখেয়াল। তাঁর সাহচর্যে দ্বিজেন্দ্রলাল একজন দক্ষ সঙ্গীতকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর প্রেম ও বিরহমূলক বেশকিছু গান সুরেন্দ্রনাথ প্রবর্তিত এ টপখেয়াল রীতিতে রচিত।
১৯০৩ সালে স্ত্রী সুরবালার মৃত্যু দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীতজীবনে বিরাট পরিবর্তন আনে। আনন্দ ও হাসির গান রচনার ভুবন থেকে তাঁর বিচ্যুতি ঘটে। এক সময় যিনি দাম্পত্য প্রেমের আবেশে রচনা করেছিলেন: ‘তোমারেই ভালবেসেছি আমি/ তোমারেই ভালবাসিব। তোমারই দুঃখে কাঁদিব সখে/ তোমারই সুখে হাসিব\’- স্ত্রী-বিরহক্লিষ্ট সেই তিনিই আবার লেখেন: ‘আজি তোমার কাছে/ ভাসিয়া যায় অন্তর আমার/ আজি সহসা ঝরিল/ চোখে কেন বারি ধার?’
অসাধারণ শিল্পকর্মের মূলতত্ত¡ যে সত্য, সুন্দর ও আনন্দ- দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীতকর্মে তার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে; তাই তাঁর গানে রয়েছে মৌলিকত্বের ছাপ। বাংলা কাব্যসঙ্গীতে তথা আধুনিক বাংলা গানে সুর, ভাব ও বিষয়ভিত্তিক রচনায় বিভিন্ন ধারার সমন্বয়করণ দ্বিজেন্দ্রলালের এক মহৎ কীর্তি। একটি সুস্থ সঙ্গীতপরিমন্ডল সৃষ্টিতে তাঁর এ অবদান বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৩ সালের ১৭ মে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
গ্রন্থপঞ্জি দিলীপকুমার রায়, মহানুভব দ্বিজেন্দ্রলাল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৬; করুণাময় গোস্বামী, সঙ্গীতকোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫; সুধীর চক্রবর্তী, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়-স্মরণ বিস্মরণ, কলকাতা, ১৯৮৯ ও বাংলা গানের সন্ধানে, কলকাতা, ১৯৯০। সূত্র : বাংলাপিডিয়া