দেশ ছেড়ে বিদেশে খেলায় মগ্ন ঠিকাদার

41

রাহুল দাশ নয়ন

সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করলেও এখনও সংযোগ সড়ক ও খাল খনন কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড। যে কারণে জেলা পরিষদের মালিকানাধীন ঘাটটি সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসছে না। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে কাজ শুরু হলেও ছয় বছরেও শেষ হয়নি প্রকল্পটি। প্রায় ১৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পের ৬০শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ডের গাফিলতির কারণেই প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি বলেই জানিয়েছেন জেলা পরিষদ সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘এই ঠিকাদার আমাদেরকে ভোগাচ্ছে। আমরা চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে কার্যাদেশ বাতিল করবো বলেছি। ইতোমধ্যে ঠিকাদার মার্চ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করবে বলে টাইম নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও ফেল করেছেন। এখন আমরা তার কার্যাদেশ বাতিল করার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিব। প্রয়োজনে নতুনভাবে টেন্ডার করবো।’
জানা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন চৌধুরী। বর্তমানে দেশ ছেড়ে দুবাই গিয়ে তিনি ব্যবসা ও খেলাধুলায় মনোনিবেশ করেছেন। সেখানে নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। আরব আমিরাতে টি-টেন ক্রিকেট লিগের দল বাংলা টাইগারের অন্যতম মালিকও তিনি। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে আরাম-আয়েশে দিনযাপন করলেও দেশের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ নিয়ে নির্ধারিত সময়ে শেষ না করা, গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ ফেরত না দেয়ার অভিযোগ আছে এফএমসি গ্রুপের মালিক ইয়াছিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, নিজস্ব অর্থায়নে স›দ্বীপের গুপ্তছড়া জেটি, সংযোগ সড়ক এবং খাল খনন প্রকল্পটি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে গ্রহণ করা হয়। শিডিউল মূল্য ১৫ কোটি ৫৯ লক্ষ ৩৬ হাজার ৭৮০ টাকা থাকলেও সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে ১৪ কোটি সাত লক্ষ সাত হাজার ৫৭৭ টাকায় কাজটি পায় এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড। নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখনো সেটি শেষ করতে পারেনি। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে স›দ্বীপের মানুষের ঘাট পারাপার অনেক বেশি সুবিধাজনক হবে। মালামালও সহজে পারাপার করা যাবে। এতে জোয়ার-ভাটায় কাদা না মাড়িয়ে ঘাট পার হতে পারবে মানুষ। যে কারণে ঠিকাদারকে বশে রেখেই নানা কৌশলে কাজটি শেষ করতে চায় জেলা পরিষদ।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী মো. শাব্বির ইকবাল পূর্বদেশকে বলেন, ‘সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে জেটির কাজ ২০২০ সালেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে সেটি হয়নি। তবে সময় বেশি গেলেও আমরা ঠিকাদারকে বুঝিয়ে জেটি ও টার্মিনাল কাজ শেষ করেছি। এখনো খাল খনন ও সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়নি। ঠিকাদার কাজটি যথাসময়ে শেষ না করায় ৭৩ লক্ষ টাকা জামানত জব্দ করেছি। এছাড়াও দেড় কোটি টাকার বিল আটকে রেখেছি। এমন অবস্থা হয়েছে ঠিকাদারের পক্ষে যারা কাজ করছেন তারাও বিপাকে আছেন। অনেক সময় তারা বেতন পর্যন্তও পাচ্ছেন না। অথচ ওই ঠিকাদার দেশের বাইরে ভালোই আছেন।’
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘পুরো প্রকল্পের কাজের ৬০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। জেটির কাজ পুরোপুরি শেষ। এখন খাল খনন ও সংযোগ সড়কের কাজ চলছে। ঠিকাদার নিয়ে কী বলবো, তিনি না থাকায় আমরা প্রাথমিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। আপাতত ঠিকাদারের স্টাফরাই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের কর্মকর্তা উত্তম ঘোষ পূর্বদেশকে বলেন, ‘নানা প্রতিকূল অবস্থার জন্য নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি। জেটির কাজ শেষপর্যায়ে। এখন ড্রেজিং কাজ বাকি আছে। রোডের কাজ স্থানীয় একজন চেয়ারম্যান করছেন। আমরা কাজ শেষ করতে মার্চ পর্যন্ত সময় নিয়েছিলাম। সময় আবারও বাড়ানোর আবেদন করবো।’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ইয়াছিন চৌধুরী বিদেশে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি দুবাই থাকেন। মাস দেড়েক আগে এসে আবারও চলে গেছেন। সেখানে খেলাধুলা নিয়ে কাজ করেন। বিভিন্নরকম ঝামেলার মুখোমুখি হওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে বলেও জানান তিনি।’
এদিকে প্রকল্প কাজ শেষ না হলেও গত বছরের ১৯ অক্টোবর তড়িঘড়ি করে গুপ্তছড়া জেটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ সালাম। গত ২৩ অক্টোবর সাংবাদিকদের সাথে জেলা পরিষদ কার্যালয়ে বিদায়ী সাক্ষাতে মিলিত হয়ে গুপ্তছড়া ঘাট নিয়ে প্রশ্নের জবাবে এম.এ সালাম বলেছিলেন, ‘নিজস্ব অর্থায়নে আমরা কাজটি শুরু করলেও এই ঠিকাদার ভালো পড়েনি। তিনি অনেক বড় ব্যবসায়ী হলেও এ ব্যবসার চেয়ে তিনি ক্রিকেট খেলার টিম দেয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। উনি অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজ শেষ করতে পারেননি। আমরা আশা করেছিলাম এক বছর আগেই শেষ করবো। আমরা সফলভাবে এই জেটি ব্যবহার করতে পেরেছি। তাই আগেভাগেই উদ্বোধন করে ফেলেছি।’