দেশ ও জনগণের স্বার্থে তেলের দাম কমানো জরুরি

29

অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখার শিরোনাম মনে পড়ে গেলো। ‘দাম শাসন দেশ শাসন’ শিরোনামে তাঁর লেখাটির বক্তব্য ছিল, যে সরকার দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে পারেন, সে সরকার জনগণের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। দাম শাসন একটি কঠিন কাজ। কিন্তু কোন সরকার আন্তরিক হলে দেশের দ্রব্যমূল্যের দাম জগণের ক্রয়ক্ষমতা তথা সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার অর্থনৈতিক সূত্র হলোÑ উৎপাদন কম হলে মূল্য বাড়বে, আর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি হলে মূল্য কমবে। অর্থনীতির এ সাধারণ সূত্র নিয়ে বর্তমানে বিশ্ববাজার এমনকি দেশের বাজারও চলছে না। এর মূল কারণ হলো মানবীয় মূল্যবোধের পরিবর্তন তথা বিপর্যয়।
আরব্য রজনীর ব্যবসায়ী নাবিক সিন্দাবাদ মানব কল্যাণেÑ দেশ থেকে দেশে ঘুরে ঘুরে সওদা করেছে। তার ব্যবসার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের অন্ন-বস্ত্র ও নানা রকম সংকট হতে মানুষকে মুক্তি দেয়া। মানব কল্যাণে ব্যবসায়ী বর্তমানে দেশ-বিদেশে খুবই বিরল। নিজের লাভ আর ধনের পাহাড় গড়ার জন্য বর্তমানে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে। ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ এবং বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হবার জন্য এ পৃথিবীতে সবধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম এবং লোক ঠকানোর কাজে লিপ্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। যার ফলে ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের কাছে আমাদের দেশ এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছে। ব্যবসীয়ারা সিন্ডিকেট, দুর্নীতি, গুদামজাতসহ নানা অপকৌশলে ক্রেতা সাধারণকে ঠকিয়ে শোষণ করে চলেছে।
দেশের গাড়ির মালিক-শ্রমিকরাও ব্যবসায়ী। তারা ভয়ঙ্কর ব্যবসায়ী। আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে মানুষ পরিবহন শিল্পের উপর ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল। মালামাল ও যাত্রী পরিবহন উভয় ক্ষেত্রে সড়ক পথের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ার পর যানবাহন ও পণ্য পরিবহণ উভয় সেক্টরের মালিক-শ্রমিকরা শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করেছে। তারা সময় অসময়ে নিজস্ব ব্যবসা চাঙ্গা রাখার স্বার্থে জনগণের উপর অবৈধ প্রভাব বৃদ্ধি করার অপকৌশলে লিপ্ত। তাদের কাছে সরকারের অবিবেচক একটি লোভী পক্ষ লিপ্ত বলে ধারণা সাধারণ নাগরিকদের।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের মূল্যের উপর পরিবহন সেক্টর সরাসরি সম্পৃক্ত। তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি হলে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা ধর্মঘট করে জনগণকে জিম্মি করে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে গাড়িভাড়া বৃদ্ধি করে। সরকার যে ভাড়া বৃদ্ধি করে তা পরিবহণ মালিক-শ্রমিক পক্ষ মানতে দেখি না। সরকার কিলোমিটার প্রতি ২৫ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধি করলে গাড়ির শ্রমিকরা মালিক পক্ষের সহায়তায় দুই-তিনগুণ হারে যাত্রীদের নিকট হতে ভাড়া বাড়িয়ে আদায় করে। দেশের সড়কে যে সকল গাড়ি চলে তাতে কোন ভাড়ার তালিকাও থাকে না। কখনো কখনো মনগড়া একটা তালিকা পরিবহণ সংগঠনের কর্তাব্যক্তিদের ভ‚য়া স্বাক্ষরে হয় তো দেখায়। তেল ও গ্যসের দাম বাড়লে গাড়ি ভাড়া বাড়াতে যতটুকু পরিবহণ সংগঠনগুলো তৎপর থাকে তা তেল -গ্যাসের দাম কমলে কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া থাকে না। সরকার পক্ষও তেল গ্যাসের দাম কমলে গাড়ি ভাড়া কমানোর কোন প্রজ্ঞাপন জারি করতে দেখা যায় না। গাড়ি ভাড়া বাড়লে তার প্রভাব পড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামেও। বাজারের শাকসব্জি হতে সব ধরনের পণ্য বিক্রেতারা পরিবহণ খরচ যত বাড়ে তার চেয়ে তিন চারগুণ দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়তি রাখে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। যা আমরা বিগত অর্ধশত বছর ধরে দেখছি। বারবার স্বল্প আয়ের মানুষের রোজগার না বাড়লেও জীবনযাত্রার ব্যয়ভার দ্রæত বাড়তেই থাকে। ফলে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ ও কষ্টের জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি পায় না। সরকার কিছু সংখ্যক গাড়ির মালিক শ্রমিক পক্ষকে যত দ্রæত খুশি করে, সে তুলনায় বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন যন্ত্রণা লাঘবে পদক্ষেপ নেয় না।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির কথা ব্যক্ত করে সরকার জ্বালানি তেলের দাম লিটার প্রতি এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য কমে যাওয়ার খবর দেশের সকল প্রচার মাধ্যমে প্রচার হবার পরও গাড়ি ভাড়াসহ দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার ও প্রশাসন। ইচ্ছে করলে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে গাড়ি ভাড়া ও পরিবহণ খরচ কমানোর ঘোষণা দিতে পারে। যারা তেলের দাম বৃদ্ধিতে গাড়ি ভাড়া বাড়ানোর দ্রæত সিদ্ধান্ত দিলো, তারা বর্তমানে জ্বালানি তেল গ্যাসের আন্তর্জাতিক দরপতনে চুপ কেন তা রহস্যজনক।
সরকার ব্যবসায়ী ও গাড়ির ব্যবসায়ীরা জনগণের সেবার মানসিকতায় কাজ করলে দেশে যাত্রী সাধারণের নিকট হতে যেমন খুশি ভাড়া আদায়ের পরিবেশের পরিবর্তন হতো। ব্যবসায়ীরা দ্রব্য মূল্যের বিষয়ে উৎপাদন খরচ, পরিবহণ খরচ অনুসারে দ্রব্যের দাম নির্ধারণ করতে দেখা যায় না। দ্রব্য মূল্য নির্ধারণে কোন রকম নিয়মনীতি এদেশে গড়ে ওঠেনি। যার ফলে দশমণ মালের উপর ৫ টাকা গাড়ি ভাড়া বাড়লে ব্যবসায়ীরা কেজি প্রতি পাঁচ বা দশটাকা দ্রব্য মূল্য বাড়তি রাখতে শুরু করে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে কখনো পরিবহণ খরচ ও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল হবে না। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য, গাড়িভাড়া, পণ্য পরিবহণ খরচ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। নিয়ম প্রতিষ্ঠায় সরকার ও সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে দেশে যানবাহন-পরিবহণ ব্যবসায়ীসহ সবধরনের ব্যবসায়ীরা নিয়মের মধ্যে চলে আসতে বাধ্য। এ ডিজিটাল সময়ে সরকার যেকোন কল্যাণমূলক সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিলে তা সারাদেশের মানুষ অবগত হয়ে যাবে। পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। যত সমস্যা ততই সমাধান। সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় সরকার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম কমিয়ে দিলে পণ্যের বাজার ও সবধরণের পরিবহণ ভাড়ায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এমন ধারণা বিশেষজ্ঞদের। গাড়ির ভাড়া সরকারি ভাবে পুননির্ধারণ করার সাথে সাথে সবধরনের পণ্যের মূল্যও কমে যাবে। ফলে সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন যাত্রায় স্বস্তি ফিরে আসবে।