দেশে কারা সুখে আছে ?

9

মোহাম্মদ অংকন


সামান্য বৃষ্টি পড়লেই রিকশার ভাড়া কয়েক গুণ বেড়ে যায়। অফিস শুরুর সময় রিকশার ভাড়া বেড়ে যায়, বেড়ে যায় অফিস শেষ হওয়ার সময়ও। যানজট লাগলে তো কথাই নেই। সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রিকশা থেকে নেমে নির্ধারিত ভাড়া বিশ টাকা দিতেই রিকশাওয়ালা ত্রিশ টাকা চেয়ে বসলেন। বললাম, ‘ভাড়া তো বিশ টাকা-ই। আমি তো রোজ আসা-যাওয়া করি, ভাই।’ তিনি বললেন, ‘অফিস থেকে ফেরার সময় এখন, ভাড়া একটু বেশি-ই পড়ে। যাত্রীর চাপও বেশি।’ বুঝতে পারলাম, রিকশাওয়ালাদের কৌশল এটা। যখন যাত্রীর চাপ বেশি থাকে, যখন হাতের নাগালে রিকশা মেলে না, তখন ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়ে নেয়। প্রতিবাদ করলে অজুহাত দেখায়। ঘটনা তো আসলে উল্টো হওয়ার কথা ছিল। যখন যাত্রীর চাপ থাকবে, তখন তো তারা বেশিসংখ্যক যাত্রী পাবে, বেশি ‘ট্রিপ’ দিতে পারবে, আপনা-আপনি বেশি আয় হবে। নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে বেশি চাওয়ার কী দরকার? কিন্তু না, তারা উল্টোটা করবে। এই কারণে করবে, পিক-আওয়ারে আয় করে বাকি সময় বিশ্রাম নেবে। কিংবা অন্য সময় যাত্রী না পেলেও চলবে। কম সময়ে, কম পরিশ্রমে যদি বেশি টাকা আয় করা যায়, সেটাই তো ভালো! এতে কার পকেট কাটা গেল, তাতে অন্তত তাদের যায়-আসে না। শ্রমিকশ্রেণির মানুষের কি আবার নীতি-নৈতিকতা আছে?
অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে সেদিন এক রিকশাওয়ালাকে জিগ্যেস করলাম, ‘ভাই, এই যে সামান্য বৃষ্টি পড়লে, অফিস-টাইমে আপনারা রিকশার ভাড়া দ্বিগুণ করে ফেলেন, এর কারণ কী?’ তিনি কোনো সদ্যুত্তর দিতে পারলেন না। বরং আমি তাকে বললাম, ‘আপনারা প্রান্তিকশ্রেণির মানুষ। আমরা কিন্তু আপনাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলি। আমরা চাই, দেশের দারিদ্র্যশ্রেণির মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাক, তাদের পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য যেন পায়।’ বুঝলেন কিনা, জানি না, শুধু তিনি হাসলেন। রিকশা থেকে নেমে তার দিকে তাকালাম, মনে হয় না- আমার কথায় তার বোধোদয় হয়েছে। হবেই-বা কী করে! দলের সবাই যদি দিনশেষে দু-তিন হাজার টাকা আয় করে বাড়িতে ফেরে, আর তিনি বা তার মতো নীতিবান কয়েকজন কম টাকা নিয়ে ফেরেন, তা তো কোনোভাবেই মানা যায় না। এই যে রিকশাওয়ালা বা এই শ্রেণির কিছু মানুষ যারা কিনা কায়দা-কৌশল করে, সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে ঠকায়, তারা কি নিজেরা কখনও ঠকে না? অবশ্যই ঠকে। এবং এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়াও বটে। ধরেন, ঐ রিকশাওয়ালা সবজির দোকানে যায়। সেখানে তিনি তার নিত্যদিনের বাজার-সদাই করেন। এখানে ঐ বিক্রেতারাও কিন্তু নানান অজুহাতের বাণী শুনিয়ে দাম বাড়িয়ে সবজি বিক্রি করেন। বলেন, আজ ওমুক সবজির চালান আসেনি। ওমুক এলাকায় ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা হওয়ায় ওমুক সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। আজকাল পর্যাপ্ত উৎপাদন নেই। আসলে ক্ষেত্রবিশেষ এর কোনোটাই ঘটে থাকে না। কৌশলে বেশি দামে বিক্রি করতে হবে, এই তো তাদের আসল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে- রিকশাওয়ালা তার যাত্রীদের থেকে বেশি ভাড়া আদায় করে তার মতোই সুবিধাভোগীর কাছ থেকে বেশি দামে সবজি কিনছে। প্রবাদের ভাষায় বলতে হয়- লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়।
কথা হচ্ছে, রিকশাওয়ালা কোথায় ঠকছে না কি ঠকছে না, সেটা মুখ্য বিষয় না। তার মতো সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সবজিওয়ালা তথা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ঠকছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে- একটা শ্রেণির মানুষ সবখানেই প্রতারিত হচ্ছে। আর সেই শ্রেণির মানুষ-ই এই সমাজে চরম বিপাকে আছে। ঘুম থেকে উঠেই তাদের শুনতে হয়- রিকশার ভাড়া বেড়েছে, বাসের ভাড়া বেড়েছে, সবজির দাম বেড়েছে, মাছের দাম বেড়েছে, কোনো কিছুই আর নাগালে নেই। কিন্তু এসব কারা বাড়াচ্ছে, আসলে কোনো যৌক্তিক কারণে বাড়ছে কিনা, আদৌ এসবের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় সরকারের রাজস্বখাতে প্রভাব পড়ছে কিনা, এসবের কোনো হদিস আসলে মেলে না। যার যেমন মন চায়, এই দেশে সেবা ও দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। কমে না কখনও। এসব দেখার যেন কেউ নেই। আর দেখতে দেখতে সাধারণ জনগণের পিঠের ছাল ক্ষয় হয়েই যায়।
আমি যে এলাকায় থাকি, চলতি বছর সেখানে আগে একটা শার্ট বা প্যান্ট লন্ড্রিতে খরচ পড়তো সাত টাকা। হঠাৎ সেদিন লন্ড্রিওয়ালা দশ টাকা প্রতি পিসে চেয়ে বসলেন। আমার চোখ তো কপালে ওঠার জো। সেবার দাম বাড়ার কারণ জিগ্যেস করতেই বলে উঠলেন, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। অথচ তখনও বিদ্যুতের দাম বাড়েনি। কেবল প্রস্তাবনা এসেছে যে কতটুকু দাম বাড়ানো যায়। সেটা শুনেই তাদের ত্বড়িৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘এই দাম নির্ধারণ কি নিজের মনগড়া? সাত টাকা ছিল, এখন না-হয় আট টাকা হতে পারে। তাই বলে দশ টাকা?’ তখন তিনি আমাকে একটা তালিকা দেখিয়ে বললেন, ‘এটা আমাদের লন্ড্রি সমিতি থেকে নির্ধারণ করা।’ বুঝতে পারলাম, এইসব প্রান্তিক সেবাদাতাদেরও ‘মাথা’ আছে যাকে তারা সমিতি নাম দিয়ে চালায়। লন্ড্রি সমিতি, সেলুন সমিতি, মুচি সমিতি, কাঁচাবাজার মালিক সমিতিসহ এ জাতীয় সমিতিগুলো আবার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদদপৃষ্ঠে চলে। অর্থাৎ প্রতি মাসে তাদের চাঁদা দিতে হয়। আর সে চাঁদার অংকটা পরোক্ষভাবে যায় জনগণের পকেট থেকেই, তা বুঝতে কারও বাকি থাকে না। সাধারণ জনগণ যেন সবখানেই ধরাসাই।
এই যে ব্যবসায়ী ও সেবাদাতাদের মুখে শোনা যায়- বিদ্যুতের দাম বাড়ায়, গ্যাসের দাম বাড়ায় আমরাও দাম বাড়িয়েছি। কোনো চাকরিজীবীর মুখে কি শোনা যায়- এসব কারণে তাদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে? কখনই না। দিন দিন সবকিছুর দাম হাতের নাগালে চলে যাওয়ায় চাকরিজীবীরা আছে মহাবিপাকে। ব্যবসায়ীরা শাখের করাত হয়ে টিকে আছে। উৎপাদনকারীকে বলছে, এই পণ্য মানুষ বেশি দামে কিনতে চায় না। দেশের পরিস্থিতি খারাপ, তাই ব্যবসায় মন্দা। আবার সেবাগ্রহীতাকে বলছে, পণ্য ঠিকমতো আমদানি করা যায় না। কৃষিজ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, দেশের মিলকারখানার অবস্থা ভালো না। তাই মজুদ নেই। চাহিদার চেয়ে যোগান কম। কদিন পর আর এসব দ্রব্য পাওয়া যাবে না। তাই বেশি দামে বিক্রি না করে আমাদেরও উপায় নেই। এই যে ব্যবসায়ীদের উভয়মুখী আচরণ, এ কারণে দেশের পরিস্থিতি যাইহোক, কখনও ব্যবসায়িক মন্দায় পড়তে হয় না। তাদের জানা আছে- কীভাবে গ্রাহককে ঘোল খাওয়াতে হয়।
বর্তমানে সবক্ষেত্রেই অস্থিরতা বিদ্যমান। সরকার চেষ্টা করেও কিছু কুচক্রী মহলের সাথে পেরে উঠছে না। যার কারণে সাধারণ জনগণ সরকারকে দোষারোপ করছে। মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বলা হচ্ছে- সরকার শুধু ব্যবসায়ীদের পক্ষে। কেননা, তারা রাজস্বখাতকে চাঙা রাখে। আসলেই কি সব ব্যবসায়ী সঠিকভাবে করারোপ করে থাকে? মোটেও না। বরং সাধারণ জনগণই পরোক্ষ করের মাধ্যমে দেশের আর্থিকখাতকে স্থিতিশীল রাখতে ভ‚মিকা রাখে। কোনো পণ্য কিনলে বা সেবা নিলে তাদের তো প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট দিতেই হয়। কিন্তু জনগণের এই ভ্যাট তারা কি রাজস্বখাতে জমা করে? লাখ টাকার কর, হাজার টাকায় বন্দোবস্ত করে সরকারের চোখে ধুলো দেয়।
বলা চলে- এই সময়ে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, তারা আছে মহাসুখে। আর যারা কিনা সরকারি-বেসরকারি চাকরিক্ষেত্রে আছে, তারা তাদের আয় দিয়ে কোনোমতে দিনগুলো পার করে নিচ্ছে। আর যারা চাকরি-ব্যবসা কোনোটাতেই নেই, তারা আছে রাজার নীতি তথা রাজনীতিতে। এই নীতিই সবচেয়ে লাভজনক এখন। অথচ রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল মানুষের ন্যায্যতা আদায়ের পক্ষে; সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মানুষ যাতে সঠিক সেবা পায়, তার নিশ্চয়তা বিধান করার কথা স্থানীয় প্রতিনিধি তথা রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের। আসলে যারা কিনা মানুষের সুবিধা-অসুবিধার বিষয় নিয়ে কথা বলবে, তারাই কিনা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন। নিজের খোরাক যখন জুটে যায়, তখন কে খেয়ে থাকল নাকি না-খেয়ে আছে, তা কি আর দেখার সুযোগ মেলে?
লেখক : সাহিত্যিক ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কম্পিউটার বিভাগে কর্মরত