দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট হাইকোর্টের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

46

শাহাবুদ্দীন খালেদ চৌধুরী

সম্প্রতি বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের নেতৃত্বাধীন একক হাইকোর্ট বেঞ্চ বাংলাদেশের দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (১) ইন্টারন্যাশনাল লিজিং (২) পিপলস লিজিং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বি.আই.এফ.সি) দুর্নীতি এবং অনিয়ম তদন্তে কমিটি পুনঃগঠন করেছেন। কমিটি বর্তমান দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিষদ বিবরণ দিবেন,ভবিষ্যতে করণীয় কি তার জন্য সুপারিশ করবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাদের ভূমিকা ও বিশেষভাবে খতিয়ে দেখবেন। এই ব্যাপারে তদন্ত কমিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে কোন কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করতে পারবেন।এই আদেশ দিতে গিয়ে আদালত যে সব বক্তব্য দিয়েছেন তা দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। শুনানিতে আদালত বলেছেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তদারক করার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডি.জি.এম. জি.এম. নির্বাহি পরিচালক, ডেপুটি গভর্নররা নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুলে বরং ঠকবাজ এবং দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিয়েছে। এদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত”বলে আদালত মন্তব্য করেছেন। দুদকের ভূমিকা সম্পর্কে আদালত বলেছেন, ‘পি.কে হালদারের বিষয়ে আমরা আদেশ কবে দিয়েছি, অথচ দুদক জানুয়ারিতে এসে বলল পিকে হালদার পালিয়ে গেছে।’ আদালতের পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঠকবাজ ব্যবসায়ী ও প্রতারকের দল জনসাধারনের অর্থ আত্মসাৎ করার সুযোগ পেয়েছে। সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে সচেষ্ট থাকতে বলেছেন।
অনেকদিন আগে থেকেই ব্যবসায়ী, অভিজ্ঞ এবং সচেতন ব্যক্তিদের অনেকেই বলে আসছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন ইত্যাদি সংস্থাগুলি এই ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না, এইসব সংস্থাগুলি এইসব দুর্নীতি সমূলে উৎপাটনের কঠোর ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই নেওয়া উচিত ছিল। অথচ আজকে মহামান্য হাইকোর্ট বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার থেকে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত সবাই এ ব্যাপারে দায়ী। কারণ এইসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ন্ত্রণের ভার তাঁদের হাতে ছিল।
২০০২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় এই সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা হরিলুট চালিয়েছে, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বরাবর ব্যক্তি স্বার্থের জন্য এসব প্রতারক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিয়েছে। কাজেই হাইকোর্টের মতামত অনুযায়ী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এইসব কর্মকর্তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। যদিও উপরোল্লিখিত কথাটা মহামান্য আদালতের মন্তব্য রায় নহে, কিন্তু সবচাইতে বড় হতাশার বিষয় হলো এখনো অনেক সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি ও বিচ্যুতির কথা বললে সমস্বরে অস্বীকার করে চলেছেন। ২০১৮ সালে ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ যখন বলল গত ১০ বছরে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে বাংলাদেশের ২২৫০২ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ যখন বলল যে বছরের ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাঁচার হয়। তারপরও এসব আমলাদের পক্ষে রাতদিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অনর্গল মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করতে বিবেকে বাঁধে না। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিরাট অংকের খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের বাইরে যে ৩৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে,সেখান থেকে ও প্রায় ১০ টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি পরিকল্পিত উপায়ে ধ্বংস করে দেওয়ার পিছনে দুর্বৃত্তদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা কি? এই ব্যাপারে ও অনুসন্ধান করা একান্ত জরুরি।
বর্তমানে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে পুঁজির ঘাটতি শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি সম্মিলিতভাবে পুঁজি ঘাটতির কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাবরে পেশ করেছে এবং ৭ হাজার কোটি টাকা পুঁজি হিসেবে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। আবেদনে যুক্তি হিসেবে যা বলা হয়েছে বলে শোনা যায় তা হলো ইতিমধ্যেই দেশের খেলাপি ঋণের জর্জরিত ব্যাঙ্কগুলিকে অনুরূপভাবে মূলধন এর ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাহলে পরিবর্তন কি হলো?
দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এসব ঋণখেলাপিদের ডাকাত নামে আখ্যায়িত করেছিলেন অনেক ঋণ খেলাপি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ঋণ নিয়ে কোন ব্যবসা তে নিয়োগ না করে সমস্ত টাকা নিয়ে বিদেশে সপরিবারে পাঁড়ি দিয়েছিল। ইহাকে যদি ডাকাতি বলা না হয় তাহলে ডাকাতি কাকে বলা হবে? এরূপ ভয়াবহ ডাকাতি করতে ব্যাংকের যে সব ব্যবস্থাপক, মহাব্যবস্থাপক, ম্যানেজার এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে কোন শাস্তি হয়েছে বলে শুনা যায় না। ব্যাংকের গচ্ছিত টাকাগুলির নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব কি উপরোক্ত কর্মকর্তাদের ছিল না?সাধারণ মানুষের রক্ষিত টাকা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ছিনিমিনি চলছে, অথচ এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব বন্ধ করার জন্য কার্যকরী কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না। ফলে টাকাগুলি সফলভাবে লুঠেরেরা নিয়ে গেল।ব্যাংকের যে সব কর্মকর্তারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলায় সাহায্য, সহযোগিতা করেছে তাদের কাউকে এখন ও পর্যন্ত কোন বিচারের সম্মুখীন করা হলো না। সাধারণ মানুষের টাকার ব্যাপারে দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যাংক অফিসারদের কোন করণীয় নেই? বাজারে জোর গুজব রয়েছে যে পি. কে হালদার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাত্র দুইজন উচ্চ পদস্থ অফিসারের সাহায্যে এবং সংঘটিত প্রতিষ্ঠানের ১০০ জনের মতো লোককে এই কাজে ব্যবহার করেছিল। অথচ দেশের সম্পূর্ণ ব্যাংকিং সিস্টেমে নাকের ডগায় বড় সাফল্যের সহিত হালদার তাঁর কাজ সম্পন্ন করেছে। এখন যদি বলা হয় আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেম সঠিকভাবে চলছে এর থেকে প্রতারণামূলক বাক্য আর কি হতে পারে?
যাই হউক, প্রশান্ত কুমার হালদারের এর ঋণ কেলেঙ্কারীর ঘটনায় তদন্তের আওতায় এসেছে তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তদন্তের জন্য ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে, পিকে হালদার কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার উপরে ঋণের নামে আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। তবে তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে এই ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এর সাবেক এমডি রাশেদুল হক কে গ্রেফতার করে। তিনি ইতিমধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সে জবানবন্দিতে পি. কে হালদারের ঋণ কেলেঙ্কারির সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী, এস কে চৌধুরী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক শাহ আলকের নাম ও উলে­খ করা হয়।
এরপর পি. কে হালদারের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এর সাবেক এম,ডি রাশেদুল হক দাবি করেছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অনিয়ম চাপা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দিতে হতো আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব অনিয়ম ম্যানেজ করতেন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এস.কে সুর চৌধুরী।
যাই হউক, দেশটাতে প্রশান্ত কুমার হালদার এস. কে সুর চৌধুরী, শাহ আলমের মতো ডাকাত সর্দার সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশের আপামার মেহনতী জনসাধারণের সততা, নিষ্ঠা এবং বিরামহীন পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত না হওয়ার জন্য আমাদেরকে এসব ডাকাতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এই ব্যাপারে যারা কালক্ষেপণ করবে তারা কোনদিন বাংলাদেশের মিত্র হতে পারে না।
লেখক: কলামিস্ট