দেনমোহরের চাপাচাপিতে চট্টগ্রামে বাড়ছে তালাক

45

নিজস্ব প্রতিবেদক

মাত্রাতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য করার কারণে স্ত্রী কর্তৃক তালাকের প্রবণতা বাড়ছে। একই সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পর বিশাল অংকের দেনমোহরের বোঝা টানতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় ছেলেপক্ষকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) দুই শিক্ষকের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
চবি আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন ও পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ভ‚ইয়া ‘মাত্রাতিরিক্ত দেন মোহর স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদানে উৎসাহিত করে কিনা’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালনা করেন। দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক আইন বিষয়ক জার্নাল ‘বাংলাদেশ জার্নাল অফ ল’ তে গবেষণাটি প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়।
চট্টগ্রামের তালাকপ্রাপ্ত ১৭৮ জন নারী-পুরুষের তথ্য সংগ্রহ এবং চট্টগ্রাম পারিবারিক আদালতের নথি ও কাবিননামা পর্যালোচনা করে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন জানান, স্ত্রীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা এবং মাত্রাতিরিক্ত দেনমোহর একত্র হলে স্ত্রী-কর্তৃক তালাক প্রদানের প্রবণতা বেড়ে যায়। অন্যদিকে দেখা যায়, দেনমোহর কম থাকলে স্ত্রীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা থাকলেও তারা তালাক প্রদানে কম উৎসাহিত হয়। তার মানে এমন নয় যে, বাংলাদেশের নারীদের পক্ষে দেনমোহর আদায় খুব সহজ ব্যাপার। আমরা এ গবেষণায় তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে শুধুমাত্র এটুকু সীমিত উপসংহারে এসেছি যে, স্ত্রীর তালাক প্রদানের প্রবণতা তখন বেড়ে যায়, যখন তার হাতে তালাক প্রদানের ক্ষমতা থাকে এবং দেনমোহরের অংকটাও বড় হয়। যেহেতু বিবাহ সমাজের ভিত্তি, এই ভিত্তি দুর্বল হয় এমন বিষয় থেকে সমাজকে কিভাবে বাঁচানো যায় তা নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।
গবেষণায় বলা হয়, অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্যকরণ এবং কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে ‘স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান’- এই দুইয়ের প্রভাবে চট্টগ্রামে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। যার বেশির ভাগই স্ত্রী কর্তৃক। এই তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে দেনমোহর গড়ে ৯ লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৯ টাকা এবং পুরুষ কর্তৃক তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে গড় দেনমোহর ৭ লাখ ২১ হাজার ৩৪৬ টাকা। গ্রামের তুলনায় শহরে দেনমোহরের পরিমাণ বেশি। তবে শহরাঞ্চলে স্বামী কর্তৃক তালাক প্রদান করার ক্ষেত্রে গড় দেনমোহর ৬ লাখ ৩০ হাজার ৮৯ টাকা এবং স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে গড় দেনমোহর ১১ লাখ ৫৬ হাজার ২১৪ টাকা।
আদালতের নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫৫.৯ শতাংশ তালাক প্রদান করা হয় স্ত্রীর পক্ষ থেকে এবং ৪৪.১ শতাংশ তালাক প্রদান করা হয় স্বামীর পক্ষ থেকে। কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামের মাধ্যমে ৯৯.৫ শতাংশ পুরুষ তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেছেন স্ত্রীকে। আর স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেননি মাত্র ০.৫ শতাংশ পুরুষ। তাছাড়া, স্ত্রী কর্তৃক তালাকের ক্ষেত্রে গড় দেনমোহর ছিল ৮ লাখ ৮২ হাজার ২৮০ টাকা এবং স্বামী কর্তৃক তালাকের ক্ষেত্রে গড় দেনমোহর ছিল ৭ লাখ টাকা। উচ্চশিক্ষিত নারীর ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ সাধারণ নারীর চেয়ে বেশি। আবার বিয়ের এক বছরের মধ্যে তালাক সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রী কর্তৃক তালাকে গড় দেনমোহর, স্বামী কর্তৃক তালাকে গড় দেনমোহরের তুলনায় বেশি।
গবেষকরা বলছেন, স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদানকে অনেকেই নারীর ক্ষমতায় হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু অধিকহারে দেনমোহর ধার্য করে বিয়ের অল্প সময়ের মধ্যে স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদান করার ফলে ধার্যকৃত দেনমোহর আদায়ে ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে। অতিরিক্ত দেনমোহর স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে একচেটিয়া তালাক প্রদানের ক্ষমতাকে রহিত করে বলে মনে করেন অভিভাবকরা। একই সঙ্গে অতিরিক্ত দেনমোহর স্বামীর অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে, যা স্বামীর জন্য মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের কারণ।