দুর্নীতি সিডিএর, ভোগান্তি মানুষের

130

কামরুল হাসান বাদল

১। গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে রিকশাচালক প্রশ্ন করলেন, আইচ্ছা মামা ধরেন একটা হইল গিয়া সরকারপক্ষ, আরেকটা হইল গিয়া বিরোধীপক্ষ। যেমুন ধরেন ভোট আইলে পরে আমরা সরকার পক্ষরে ভোট দেই নয়তো বিরোধীপক্ষরে দেই। কিন্তুক মামা এই যে কয় কর্তৃপক্ষ সেইটা আবার কোন পক্ষ। টাউনের যেমুই দেহি হেইহানে লিইখ্যা রাহে, ‘আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’! আমি বললাম, যেইটার কাম হইল আদেশ করা কেউ মানছে কিনা তা দেখনের গরজ নাই তারে কয় কর্তৃপক্ষ। যেমুন হইল গিয়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
– হেইডা কী মামা?
-বললাম, তোমার ভাড়াটা গুইন্যা নেও। আমি যাই।
২। কাজীর দেউড়ি থেকে জামালখান আসার পথে সামান্য কিছুদূর এলে একটি ছোট্ট ব্রিজ আছে তার নিচে আজ নালার মতো যা আছে তা প্রকৃতপক্ষে একটি খাল। নথিপত্রে তা জামালখান সাবএরিয়া খাল বা কাজীর খাল নামে উল্লেখ আছে। সে ব্রিজ থেকে উত্তর দিকে তাকালে দেখা যায় একটি বিল্ডিংয়ের পাইলিং করা হয়েছে খালের জায়গা দখল করে। বছরখানেক আগে সে স্থানের ছবিসহ একটি পোস্ট দিয়েছিলাম ফেসবুকে। তা যে কোনো ‘কর্তৃপক্ষ’-এর নজরে পড়েনি তা আজ অকুস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষ করা যাবে।
৩। সে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কয়েকদিন আগে একটি ‘অবৈধ স্থাপনা’ ভাঙতে গিয়েছিল। বাদবাকি পত্রিকায় প্রকাশিত ১১ মার্চের খবরের বরাত দিয়ে বলছি, খুলশীতে গয়নার ছড়া খাল দখল করে গড়ে তোলা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) একটি বহুতল ভবনের একাংশ ভেঙে দেয়া হচ্ছে। সকাল ১০টা থেকে ভবনটি ভাঙার কাজ শুরু করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সেনাবাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন সিডিএর স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল আলম।
সিডিএ’র জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মঈনুদ্দিন জানান, খাল দখল করে অবৈধভাবে নির্মাণ করা অংশটুকু সরিয়ে ফেলতে ২০১৯ সালের অক্টোবরে ইউএসটিসিকে ৯০ দিনের সময় দেয়া হয়। কিন্তু প্রায় ১৬ মাস পার হলেও তারা অবৈধ অংশটুকু সরিয়ে নেয়নি। তাই বর্ষার আগেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছি আমরা।
তিনি বলেন, এর আগে নিজেদের জায়গায় ওই ভবন নির্মাণে সিডিএর কাছ থেকে ১৬ তলার নকশার অনুমোদন নেয়া হয়। কিন্তু নকশা না মেনে ১৮ তলা ভবন নির্মাণ করে ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ। ভবনটি নির্মাণে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ স্কয়ার ফুট খালের জায়গা দখল করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ইউএসটিসির এই ভবনটি কোনো অলৌকিক ক্ষমতার গুণে রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে নির্মাণকাজের যে ধারা তা অনুযায়ী এই ভবন গড়ে তুলতে কয়েকবছর সময় লেগেছে। এই দীর্ঘ সময়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সিডিএ’র কারো নজরে পড়লো না এই অনিয়ম? ১৬ তলার নকশা ১৮ তলা হলো, তিন হাজার পাঁঁচ শ স্কয়ার ফিট খালের জায়গা দখল হলো তা-ও নজরে পড়লো না কারো? এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান এত বড় একটি অন্যায় করলো তা দেখার কেউ ছিল না সিডিএতে? ইউএসটিসি যদি এমন অনিয়ম করে স্থাপনা তৈরি করে থাকে তবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা সিডিএ নিতে পারে। আমার তাতে দ্বিমত নেই। তবে তৈরি এই ভবন ভেঙে ফেলায় ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার দায় কে নেবে? এই দায় সিডিএ এবং সেসময় যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাঁদেরও কি নিতে হবে না? এমন অনিয়ম কি শুধু ইউএসটিসিই করেছে? তা নয়। তদন্ত করলে দেখা যাবে এই নগরের অধিকাংশ স্থাপনাই ১০০ শতাংশ নিয়ম মেনে গড়ে তোলা হয়নি। শুধু ব্যক্তিগত ও বেসরকারিবাবে নয় সরকারি স্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অনেকসময় নিয়ম মানা হয়নি। নিয়ম না মানাদের বিরুদ্ধে সিডিএ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি অতীতে।
এমন অনেক ভবন গড়ে তোলার পর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান তা বিক্রি করে লাভসহ লগ্নি তুলে নিয়ে যান। একসময় দেখা যায় সে ভবন বা স্থাপনা অবৈধ বলে ভেঙে দিচ্ছে সিডিএ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিছু নিরপরাধ মানুষ যাঁরা টাকার বিনিময়ে ফ্লাট বা দোকান কিনেছিলেন। এর দায়ভার কি সিডিএর ওপরও বর্তায় না?
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যাপক কাজ হচ্ছে। দখল হওয়া খাল উদ্ধার করা, খাল পরিষ্কার করাসহ নানাবিধ কাজ করছে সিডিএ ও সেনাবাহিনীর প্রকৌশল শাখা। ইতিমধ্যে তারা অনেক খাল দখলমুক্ত করেছে। অনেক ক্ষমতাবানদের দখল করা জায়গাও মুক্ত করেছে। ফলে শুধু ইউএসটিসির ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার আব্দার করতে পারি না। যদিও এরই মধ্যে ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ সিডিএর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছে।
তার আগে খালের চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইউএসটিসি’র উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন এ ধ্বংসযজ্ঞ যেন বন্ধ করা হয়। এর পেছনে হয়ত কোনো চক্র আছে। আপনি নির্দেশ দিন, এটা বন্ধ করুন।
এটা ভেঙে কার লাভ হল? ডিজিটাল সার্ভে করে আমাদের জমি দেয়া হয়। আগে কখনো বলেনি এখানে গয়না ছড়া খাল আছে। সিডিএ’র অনুমোদিত ভবনের নকশাতেও খালের কোনো চিহ্ন ছিল না। এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন- ভবন নির্মাণে নিয়মের ব্যত্যয় হলে সিডিএ’র আইন মতে জরিমানা করতে পারত।
৪। বাকলিয়ায় একট দশতলা ভবনের কারণে আটকে ছিল নগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণের কাজ। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে ভবনের পাশ দিয়ে সড়ক নির্মাণ করার। এই সিদ্ধান্তে আসার আগের ঘটনাবলী একটু জানা দরকার। কয়েকবছর আগে জানা গেল এই সড়ক নির্মাণ করতে হলে ভাঙতে হবে একটি দশতলা ভবন আর ভবনটি ভাঙতে হলে এর মালিককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারকে দিতে হবে ১০ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত সরকার ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল ক্ষতিপূরণ হিসেবে। তবে টাকা হস্তান্তরের কয়েকদিন আগে সিডিএ জানতে পারে ভবনটি অবৈধ অর্থাৎ অনুমোদনহীন কাজেই সরকারকে ১০ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হবে না।
২০১৬ সালের অগাস্টে ২০৫ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকায় একনেকে অনুমোদন পায় বাকলিয়া এক্সেস রোড। ৬০ ফুট চওড়া সড়কটি সিরাজউদ্দৌলা সড়ক থেকে শুরু হয়ে বাকলিয়া থানার পাশ দিয়ে যুক্ত হওয়ার কথা শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের সাথে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় আরও এক বছরের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সড়কটি নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ার কারণ হলো সড়কের জন্য নির্ধারিত স্থানে একটি দশতলা ভবনের অনুমতি দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। অনুমোদিত ভবন ভাঙতে হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এমন কথা বলে কাজ বন্ধ রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ক্ষতিপূরণের ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে। এ নিয়ে গত কয়েক বছর নানা কথা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে বহুবার সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। সিডিএ নিজেই বলেছে এ ভবন ভাঙতে হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পরে বলেছে ভবনটির কোনো অনুমোদন নেই। অনুমোদনহীন ভবনের জন্য ক্ষতিপূরণের প্রশ্নই ওঠে না। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয় সরকারি সংস্থাগুলোর প্রকল্প দেখভালের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত প্রকল্প মনিটরিং কমিটি। এই কমিটি সিডিএর প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করে এবং বাকলিয়া এক্সেস রোডের কার্যক্রম পিছিয়ে থাকার জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয় তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালামকে। এরপর প্ল্যান অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে চিঠি দেওয়া হয় তাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য। এরই প্রেক্ষিতে প্ল্যানিং বিভাগসহ অন্যান্য শাখা থেকে যে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়েছে সেখানেই প্রকৃত সত্যটি উঠে আসে। তাতে দেখা যায় ভবনটি যে দাগ নম্বরে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেখানে নেই। খতিয়ানের চারটি দাগে ভবনটি নির্মাণের নকশা জমা দিয়ে অনুমোদন চাওয়া হয়। ১৭০৫১ দাগের জায়গাতেই ভবনটির বেশিরভাগ অংশ। সিডিএ’র পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে এই দাগে তারা কোনো ভবনের অনুমোদন দেয়নি। আবেদনে ১৭০৫১ নং দাগটি ছিলই না। এই বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুর ইসলাম বলেন, “এই বিষয়টি আমি অনেক আগেই বলে আসছি। ভবনটি যে স্থানে রয়েছে আমি সে স্থানে তাকে অনুমোদন দিইনি। তাই ভবনটি অবৈধ। আর অবৈধ ভবনের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত চিঠিও লেখা হয়েছিল কিন্তু সেই চিঠি ইস্যু করার জন্য অনুমোদন দেননি তৎকালীন চেয়ারম্যান।” “যদি ভবনটি অনুমোদনহীন হয়েই থাকে তাহলে এতোবছর ভবন মালিককে নোটিশ ইস্যু করা হয়নি কেন” এমন প্রশ্ন করা হলে সিডিএ’র অথরাইজড অফিসার ও ইমারত নির্মাণ কমিটির সদস্য সচিব মনজুর হাসান বলেন, একথা শতভাগ সঠিক যে, যে দাগ নম্বরে আমরা তাকে ভবনের অনুমোদন দিয়েছি ভবনটি সে জায়গায় গড়ে তোলা হয়নি। তাই তখনকার সময়ে চিঠি ড্রাফট করে দিলেও প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএ’র চেয়ারম্যান সিডিএ’র স্বার্থে নোটিস ইস্যু করতে দেননি।’
এক্ষেত্রেও একইনপ্রশ্ন করতে পারি যে, ভবনটি রাতারাতি তৈরি হয়নি। আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের সাহায্যেও তিনি তা করতে পারেননি। দিনে দুপুরে কয়েক বছর ধরে বিশাল এই ভবনটি তৈরি করেছেন তার মালিক। এতবড় একটি ভবন অনুমোদনহীন একটি জায়গায় গড়ে উঠেছে তা জেনেও প্রধান নগরবিদ ও অথরাইজড অফিসার কোনো ব্যবস্থা নিলেন না কেন? দীর্ঘ তিন বছর ধরে কাজটি ঝুলে থাকল। শেষ পর্যন্ত সংকট নিরসনে সরকার ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের জন্য বরাদ্দ দিল তা জেনেও তারা নিশ্চুপ রইলেন কেন? মাঝখানে অনুমোদনহীন ভবনের মালিককে ১০ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হতো যে টাকা মূলত জনগণের টাকা। এর পেছনে কি তাহলে সংশ্লিষ্টদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই? টাকার ভাগ কি তারাও নিতেন বলে এমন ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন? এত বড় অন্যায়ের পরও কি তারা স্বপদে বহাল থাকবেন? তাদের কোনোই শাস্তি হবে না? এই সংস্থাটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান কি এই অনিয়মের সামান্য দায়ও বহন করবেন না? এই দশকোটি টাকা দিয়ে-জনগণের স্বার্থে কত কাজই না সরকার করতে পারত। যে দেশের হাসপাতালে টাকার অভাবে একটি এক্সরে মেশিন কেনা যায় না, যে দেশে একটি অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয়। যে দেশে ছাদবিহীন স্কুল গৃহে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হয়, যে দেশের কয়েক হাজার টাকার অভাবে অনেকে চিকিৎসা করতে না পারায় মৃত্যুবরণ করে, যে দেশে কয়েক হাজার টাকার অভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারে না, যে দেশে সরকারের ১০ কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারার এই অসাধারণ ব্যবস্থাপনা দেখে জাতির পিতার ভাষণটি মনে পড়লো, এ দেশে দুর্নীতি করে কে? এদেশে লুটপাট করে কে? সিডিএর দুর্নীতি, অযোগ্যতার ফিরিস্তি লিখে শেষ করা যাবে না। নগরের বিল্ডিংগুলোই একেকটা এর সাক্ষী। তবে বর্তমান চেয়ারম্যান একজন সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি। তিনি চেষ্টা করলে সিডিএকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারবেন।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক