দুর্নীতি ও চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার থমকে আছে

92

দুর্নীতির মামলার আসামিদের বেশিরভাগই বিত্তবৈভব ও প্রভাবশালী হওয়ায় বিচার কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশসহ বিদ্যমান নানা আইনি সুবিধা নিয়ে থাকেন। এতে এমনিতেই বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হয়। তার ওপর চলতি বছরের গত ৬ জানুয়ারি থেকে বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত রয়েছে বিচারকশূন্য। একইভাবে বিদায়ী বছরের নভেম্বর থেকেই বিভাগীয় দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালেও বিচারক নেই। গুরুত্বপূর্ণ দুটি আদালতে বিচারক না থাকায় থমকে আছে আট শতাধিক মামলার বিচারিক কার্যক্রম।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে দুর্নীতির মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর বাইরে অধিকতর স্পর্শকাতর কিংবা চাঞ্চল্যকর মামলাও বিচার সম্পন্নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই আদালতে পাঠানো হয়ে থাকে। বর্তমানে সাত শতাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে এই আদালতে। এর মধ্যে আড়াইশ’ মামলার বাদী হল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ব্যাংকের অর্থ ও সরকারি সম্পদ লোপাটসহ দুদকের আইনের তফসিলভুক্ত নানা কায়দায় দুর্নীতির অভিযোগে দুদক সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়ের করে।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, বন্দর ও কাস্টমসসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী। আবার তাদের কারও কারও স্ত্রীও রয়েছেন আসামির তালিকায়। বাকি মামলাগুলো হত্যা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনসহ বিভিন্ন আইনে দায়ের করা।
অপরদিকে, দ্রুততম সময়ে বিচার নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপিত দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে ১১টি জেলার চাঞ্চল্যকর মামলা সংক্রান্ত মনিটরিং সেলের সুপারিশকৃত মামলাগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে বিচার নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। এই ট্রাইব্যুনালে একশ’ ৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কোনও মামলার বিচার অনিষ্পন্ন থাকলে সেটি ওই অবস্থায় পূর্বতন আদালতে ফেরত পাঠানো হয়।
বিভিন্ন জেলা থেকে আসা চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে বিবেচিত একশ’র কাছাকাছি মামলা বর্তমানে এই ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন থাকলেও গত বছরের নভেম্বর থেকে বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ আদালত বিচারকশূন্য থাকায় দুর্নীতি ও চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো বিলম্বিত বিচারের ফাঁদে পড়েছে।
বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের সরকারি কৌসুলী মাহমুদুল হক মাহমুদ পূর্বদেশকে বলেন, দুর্নীতির মামলাগুলোর সাক্ষীদের একটি বড় অংশই সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ঘটনাস্থল কিংবা ঘটনার সময় তারা সংশ্লিষ্ট জেলায় কর্মরত থাকলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন জেলায় বদলি হয়ে যান। তাই মামলার ধার্য তারিখে দূরবর্তী জেলা থেকে তারা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আদালতে হাজির হলেও বিচারক না থাকায় ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু আদালতে মামলার আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষীর সাক্ষ্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকের পক্ষে কয়েক দফায় আদালতে হাজির হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। ফলে, মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হতে পারে। এমনিতে অনেক মামলার বিচার সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে। এতে বিচারপ্রার্থীরাও নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
দুদক সূত্র জানায়, বিগত ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর আদালত ভবনে উঠার পথে ব্যাগভর্তি ৫৭ লাখ ৯২ হাজার টাকাসহ গ্রেপ্তারের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার দুদকের চার্জশিটভুক্ত আসামি মো. ইলিয়াছ ভুঁইয়া চার্জ গঠনের পর্যায়ে এসে মামলাটি বাতিল (কোয়াশমেন্ট) চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। এ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রমের ওপর তিনমাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। স্থগিতাদেশের কপি বিদায়ী বছরের শেষদিকে বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে এসেছে।
বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে নিযুক্ত সরকারি কৌসুলী পিপি মাহমুদুল হক মাহমুদ জানান, আলোচিত ওই আর্থিক কেলেংকারির মামলার আসামি বান্দরবান পার্বত্য জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার সার্ভেয়ার শহিদুল ইসলাম মুরাদ দীর্ঘদিন ধরে পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে জারি করা পরোয়ানার প্রতিবেদন এখনও আদালতে আসেনি। আরেক আসামি ইলিয়াছ ভুঁইয়া হাইকোর্ট থেকে মামলার বিচারিক কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছেন। আর এখন তো বিচারকই নেই। সবমিলিয়ে এই মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করতে অনাকাক্সিক্ষত বিলম্বিত হচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠক রাণা দাশগুপ্ত পূর্বদেশকে বলেন, সরকার চলতি মেয়াদে ‘দুর্নীতি নির্মূল’ অগ্রাধিকার তালিকায় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ অবস্থায় বিচারকশূণ্যতা কিংবা অন্য যে কোনও অনাকাক্সিক্ষত কারণে দুর্নীতির মামলার বিচার বিলম্বিত হলে দুর্নীতিবাজরাই উৎসাহিত হবেন। অপরদিকে, মামলার আসামিদেরও জামিন প্রার্থনার সুযোগ কিংবা জামিন পাওয়া আইনগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। যদি বিচারকই না থাকেন, তাহলে মামলার সব পক্ষই তো তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ দুটি আদালতে বিচারক নিয়োগ দিয়ে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই বিদ্যমান সঙ্কট কাটিয়ে উঠা যাবে বলে আশা করছি।