দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে জবাবদিহিতার বিকল্প নেই

29

অমল বড়ুয়া

দেশ ও জনগণের উন্নতি, প্রগতি ও কল্যাণ নির্ভর করে সেই দেশের সরকার ও প্রশাসনের স্বচ্ছতা নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার উপর। সরকার ও প্রশাসনে স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা থাকলে দেশে সুশাসন থাকবে আর এতে করে জনকল্যাণ ও প্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। বিশ্বের দেশসমূহ এখন ঝুঁকছে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন মূলত সুশাসনের হাত ধরে। আর এই সুশাসনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে জবাবদিহিতা। জবাবদিহিতার অভাবে সরকারি প্রশাসনে আইন লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মত ঘটনা ঘটে। এতে ব্যাহত হয় দেশের উন্নতি ও সুশাসন। ক্ষমতার অপব্যবহার করেও সে বিষয়ে জবাবদিহিতার অভাবের কারণে প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। নিকট অতীতের কিছু ঘটনা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। যেমন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৈরিকৃত বই তালিকায় একজন উপসচিবের ২৯টি বই অর্ন্তভুক্ত হওয়া কিংবা উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার অপেক্ষায় থাকা ফেরীতে স্কুল ছাত্রের মৃত্যু কিংবা পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়সমূহকে জবাবদিহিতার আওতায় না আনা দেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি! বাংলাদেশের সুশাসনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জবাবদিহিতার অভাব।
জবাবদিহিতা সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রের সর্বত্র সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে জবাবদিহিতা। সুশাসনে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি নাগরিক সেবাদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। জবাবদিহিতার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কৈফিয়ত; কোন কাজের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ ও তৎসংক্রান্ত প্রশ্নাদির জবাব দিতে প্রস্তুত থাকা। অর্থাৎ সম্পাদিত কর্ম সম্পর্কে একজন ব্যক্তির ব্যাখ্যাদানের বাধ্যবাধকতা। এককথায় জবাবদিহিতা বলতে বোঝায় দায়বদ্ধতার প্রতিশ্রæতি ও দায়-দায়িত্বের স্বীকারোক্তি। জবাবদিহিতার সাথে মানবাধিকার যুক্ত। জবাবদিহিতার মাধ্যমে গড়ে উঠে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে নিবিড় আন্ত:সম্পর্ক। জবাবদিহিতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অংশগ্রহণ। জবাবদিহিতা ছাড়া কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্ভবপর নয়। তাই প্রয়োজন সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাবের জন্য দায়ি কিছু বিষয় আছে। এগুলো হল প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্বল সংসদ, অনুন্নত রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব এবং দুর্বল নির্বাচনব্যবস্থা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সংসদে কোন শক্তিশালী বিরোধীদল ছিল না। এ কারণে সংসদ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারছে না। স্বৈরশাসনও জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে আঘাত হেনেছে। তাছাড়া আমলারা অনেক সময় জনগণের সামনে সঠিক ও সত্য তথ্য প্রচার করতে চায় না। শাসকশ্রেণিরও একটি অংশ তথ্য গোপনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। এই অস¦চ্ছতা দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং সুশাসনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক জবাবদিহিতা যদি দুর্বল হয় তবে তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয়খাতকে প্রভাতি করে। দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে উঠলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতির পাশাপাশি জাতীয় অগ্রগতি বেগবান হবে এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। একই সাথে দেশের প্রশাসন, সেবাসংস্থা ও নাগরিক সমাজও জবাবদিহিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে। এতে করে দেশের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ হবে। দেশ পরিণত হবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে। রাজনৈতিক জবাবদিহিতার পাশাপাশি সামাজিক জবাবদিহিতাও সুনিশ্চিত করা জরুরী।
সামাজিক জবাবদিহিতা হল নাগরিক, সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং পরিষেবা সরবরাহকারীদের আচরণ ও কার্যকারিতার মধ্যে সুদৃঢ় মিথস্ক্রিয়া। যেখানে সরকার, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা সকলেই ন্যায়-নৈতিকতা ও সুশাসনের ভিত্তিতে সম্প্রদায়ের কল্যাণ এবং জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করে। সামাজিক জবাবদিহিতা নাগরিকসমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সংযোগ সাধন করে থাকে। এতে করে প্রতিটি কর্মপরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের জন্য নাগরিকদের কাছে রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হয়। সামাজিক জবাবদিহিতা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সরকারি নীতির বিকাশ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াগুলোর গুণমান বৃদ্ধি করে। আর এতে করে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ও জনকল্যাণে সরকার ও প্রশাসন আত্মনিয়োগ করে। মূলত সামাজিক জবাবদিহিতা ভোটের বাইরে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে নাগরিকরা রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য করে। সামাজিক জবাবদিহিতায় সরকার, নাগরিকসমাজ, মিডিয়া এবং অন্যান্য সামাজিক পক্ষগুলো সক্রিয় থাকে। এই সামাজিক জবাবদিহিতা নির্ভর করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার উপর। প্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারিদের দায়িত্বশীলতাই মূলত প্রশাসনিক জবাবদিহিতা। প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সরকারি প্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারি বা আমলাগণ তাদের কাজের জন্য অভ্যন্তরিণভাবে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন এবং বাহ্যিকভাবে সরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মাধ্যমে তাদের কাজের মূল্যায়ণ নিশ্চিত করা হয়। প্রশাসনিক জবাবদিহিতা হল আইনানুগ, নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি, বিস্তৃত নিয়ম-কানুন যার মাধ্যমে সরকারি কর্মচারির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়।
প্রশাসনে নিয়োজিত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করার জন্য জবাবদিহিতার ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করা জরুরী। আভ্যন্তরিন বা বিভাগীয় জবাবদিহিতার মাধ্যমে যথাযথ শুদ্ধাচারের আচরণ পরিলক্ষিত হয় না। কারণ এতে কর্মকর্তার কর্তব্যে অবহেলা, অর্পিত দায়িত্ব প্রতিপালনে ব্যত্যয় হলে কিংবা দোষ-ত্রæটির জন্য আইনানুগ সাজার পরিবর্তে যোগসাজশে রফাদফা করার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আবার অনেকক্ষেত্রে একজনের দোষ অন্যজনের উপর চাপানোসহ গুরুদোষে লঘুদন্ড দেয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। ঘটতে পারে ক্ষমতার অপব্যবহারও। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রদেয় কর ও বিভিন্ন ফি-অর্থ হতে বেতনসহ প্রদেয় সুযোগ-সুবিধাদি ভোগ করে থাকেন। তাই তাদের জবাবদিহিতাও জনগণের কাছে হওয়া উচিত। আর এর সুন্দর ও উন্মুক্ত মাধ্যম হতে পারে জাতীয় সংসদ, প্রিণ্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, গণ-শুনানি এবং ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনে বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর আর্বিট্রেশন কমিটি করা যায়। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে কর্মকর্তাদের স্ববিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা রদ করা উচিত। কারণ এই ক্ষমতা অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল কিংবা প্রতিশোধ পরায়ণ মনোবৃত্তিকে উসকে দিতে পারে।
জবাবদিহিতা চর্চার মাধ্যমে প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি লাঘব হওয়ার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম গতিশীল হবে, উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং জনগণ নির্বিঘেœ সেবা পাবেন। জবাবদিহিতার মাধ্যমেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নয় বরং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের জবাবদিহিতাও আবশ্যক। দুর্নীতি কমাতে ও রাজনৈতিক উন্নয়নে জবাবদিহিতা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। সুশাসন ও জবাবদিহিতা ছাড়া যেমন গণতন্ত্রকে পুর্ণাঙ্গভাবে রক্ষা করা যায় না, তেমনি গণতন্ত্র না থাকলে সুশাসন ও জবাবদিহিতাকেও প্রতিষ্ঠা করা যায় না। জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করা গেলে সরকারি অর্থ সাশ্রয় হবে; দুর্নীতি কমবে; ক্ষমতার অপব্যবহার কমবে; রাষ্ট্রীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার হবে; সুষ্ঠু উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন ফলপ্রসু হবে এবং জাতীয় উন্নতি বেগবান হবে। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে জবাবদিহিতার বিকল্প নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক