দুর্গা তত্ত্ব

84

শ্রীমৎ ভবানন্দ চৈতন্য

দুর্গা নামের অর্থই বা কী? এবার দেখি ‘দ’ শব্দটি দিয়ে দৈত্য নাশকারী, ‘উ’ কার দিয়ে বিঘ্ন নাশকারী, রেফ রোগঘ্ন ‘গ’ কার পাপঘ্ন এবং ‘আ’ কারে বুঝায় ভয় শত্রুঘ্ন অর্থাৎ- দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় এবং শত্রু হতে যিনি আমাদের ত্রাণ করে থাকেন। তিনিই হলেন মা দুর্গা। অন্য কথায় শব্দটি বিপত্তি বাচক ‘আ’ কার নাশ বাচক যিনি বিপত্তারিনীরূপে প্রকাশিত তিনিই জ্ঞানী মাঝে দুর্গা নামে আবিভুর্তা। স্কন্দ পুরানে দেখতে পাই যে স্মরণাগতদের প্রার্থনায় দেবাদিদেব ভোলানাথ শম্ভু নির্ণয়ক্রমে রুরু দৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করে বিশ্বলোকে তিনি দুর্গা নামে প্রতিষ্ঠিত হন।
শ্লোক :- দুর্গা দেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি। চণ্ডী ১১/৫০
ঋগ্বেদের দেবীতত্তে¡র দেবীসুক্ত ও রাত্রিসুক্ত। দেবীসুক্তে দেবী আপন অচিন্তনীয় মহিমা, অনন্ত শক্তি ও লীলার বিনয় ব্যক্ত করেছেন। অম্ভুন ঋষির কন্যা বাক্ দেবীর মুখে। তিনি সর্বাত্মিকা, সর্বশক্তি, সমন্বিতা, সর্বব্যাপিনী এবং সর্বদ্রষ্টা, তিনি বসুগণকে ধারণ করেন। আবার একাদশ রুদ্ররূপে সমগ্র ধারায় বিচরণ করেছেন। বিষ্ণু আদি সমগ্র আদিত্য দিগকে ধারণ করেন। তিনি নিখিল বিশ্বের অধিশ্বরী। তিনি ধনাদি অধীষ্টাত্রী, সর্বদর্শিনী, উপাসকগণের মধ্যে প্রধানা। তিনি প্রভৃতি পদার্থের জীবনী শক্তিরূপে প্রকাশিতা। তিনি নির্লিপ্তা, কুটস্তা ব্রহ্ম চৈতন্য রুপিনী আবার স্ব মহীমায় পৃথিব্যাধিতে সমস্ত লোকেই অধিষ্ঠিতা। তিনি তন্ত্রসারুক্তো মার্কেন্ডয় পুরানের অন্তর্গত শ্রী শ্রী চণ্ডীতে উক্তি করেছেন – ‘একৈ বাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা’। আমার দ্বিতীয় কোন সত্ত্বা নেই জগতে আমি একাই বিরাজিতা আমা ভিন্ন অতিরিক্ত আর কেউ নেই।
এই অদ্বৈত তত্ত¡ই বেদ। পুরান এবং তন্ত্রপ্রোক্ত দেবী, দেবীতত্ত্বের মূল অংশবিশেষ। তিনি দশ মহাবিদ্যা স্বরূপা। একজনই হয়েছেন লহ্মী, সরস্বতী, উমা, পার্বতী, ভারতী, জগদ্বাত্রী, গৌরী, ব্রহ্মানী, চামুণ্ডা, কাত্যায়নী প্রত্যেকটি মায়ের ভিন্ন ভিন্ন নাম বা রূপমাত্র। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে মহাকালী, মায়ের তামসী মূর্তি। মহালহ্মী মায়ের রাজসিক মূর্তি এবং মহাসরস্বতী মায়ের সাত্তি¡কী মূর্তি। মায়ের বাহন সিংহ। সিংহ শব্দটি হিংস ধাতু থেকে উৎপন্না দুর্দমনীয় পশু। শক্তি হলো রজোগুণের প্রতীক। সমগ্র মানবের মধ্যেই এ পশু শক্তি বিরাজমান আছে। তেমনি সত্ত¡ গুণ ও রজোগুণও বিরাজমান। তবে কি করে হলো মায়ের বাহন সিংহ। দেবী পুরানে উক্ত আছে, সিংহের গ্রীবাতে বিষ্ণু, মস্তকে মহাদেব, কপালে পার্বতী, বক্ষস্থলে দুর্গা, করগ্রন্থিতে কার্তিকেয়, পাশে নাগগণ, কর্ণদ্বয়ে অশ্বনী কুমরাদ্বয়, নয়নে চন্দ্র-সূর্য, দন্তে বসুগণ, জিহ্বায় বরুন, হুঙ্কারে চণ্ডীকা, গণ্ডদ্বয়ে যম ও যক্ষ। সিংহ আমাদেরকে আত্মসমর্পণের শিক্ষা দিচ্ছে। সর্বতোভাবে সর্বক্ষণ সিংহদেবীর পদতলে সমর্পিত।
জীবন মাত্রেরই রয়েছে পশুত্ব, তাই জীব চায় পশুত্ব থেকে দেবত্বে উন্নতি হতে, আর এ জন্যেই মাতৃচরণে ঐকান্তিক শরণাগতি। তবেই হবে অন্তরে সুপ্ত দৈবী সত্ত্বার উন্মেষ। লাভ হবে দেবীর অপার্থিব করুণা। সর্বসত্ত¡ময়ী দেবী মহামায়া নিজের পক্ষে রাখলেন রজোগুণী প্রতীকী সিংহকে। জীবকল্যাণে রজোগুণাত্মিকা শক্তি সাধনার প্রয়োজনে রাখতে হয় নিজের নিয়ন্ত্রণাধীনে। না রাখলে এ শক্তি হবে বিপথগামী আর জাতির সব ধরনের মঙ্গলকে করবে পদদলিত। এতে ঘটবে নানা ধরনের হীন কর্মকাণ্ড। প্রাণ শক্তির প্রাচুর্য আছে। দেবদ্বিজ গুরু প্রাজ্ঞে আস্থাহীন যে শক্তি অসৎ পথে চালিত হয় সেতো অসুর শক্তি। সাধকের সাধনায় প্রথমে আসে অসুরের সঙ্গে সংগ্রাম তেমনি সমাজে, দেশে, রাষ্ট্রে সর্বত্র এই দৈব আসুরে সংগ্রাম।
শ্রী শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ষোড়শো অধ্যায়ে দেখতে পাই :
‘দম্ভো দর্পোহভিমানশ্চ ক্রোধ পারুষ্য মেবচ।
অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পাদমাসুরীম।। ১৬/৪ গীতা
দম্ভ, দর্প, অভিমান, নিষ্ঠুরতা ক্রোধ ও অজ্ঞানতা এসব আসুরিক সম্পদ। এ ভাবগুলি সব ধরনের মঙ্গল কাজের অন্তরায়। এ থেকে আসে কাম, কামরূপী মহিষাসুর। মহিষাসুর যখন মায়ের অতুলনীয় সুন্দরের মহিমা জানতে পারলেন তখনই তিনি মায়ের কাছে সাথে সাথে সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। কিন্তু মহামায়া সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সাথে সাথেই যুদ্ধ সংগঠিত হয়ে গেল। কামনারূপী অসুর মহিষের সঙ্গী হল। চিক্ষুর উদগ্র, চামর, অসিলোমা, বিড়ালস্য, বাস্কল, করাল, দুর্ধর্ষ দুর্মুখ, অন্ধক, তাম্র্য সকলে এদের বিশেষ পরিচিতি আছে। চামর অর্থাৎ চাঞ্চল্য, চাঞ্চল্য হচ্ছে কামনার প্রধান উপাদান। চিক্ষুর হলো কুটিলতা, মিথ্যা কুটিলতা ও মলিনতা পাপের নিত্য সহচর উদগ্র অর্থাৎ সংযম রাহিত্য এবং কুকর্মে ইন্ধন যোগানদাতা। সবসময় যিনি মনকে পাপ কাজের আগ্রহ বাড়ায়। অসিলোমা অর্থাৎ যাহার গাত্র রোম সকল তরবারি ন্যায় তীক্ষè নিষ্ঠুরতা ও নির্দয়তা। বাস্কল হলো দম্ভ, দর্প সূঢ়তা, কামাত্মা ও দুর্ষ্কমা চিরকালই দাম্ভিক ও মুঢ় হয়ে থাকে। বিড়ালাক্ষ অর্থাৎ লোভী, ধূর্ততা ও ভণ্ডামী যেমন বিড়াল আলোক ও আঁধারে সমানভাবে দেখে তেমনি লোভী ধূর্ত ও ভণ্ড ব্যক্তিরা সর্বক্ষণ চতুর্দিকে দৃষ্টি রেখে চলে না হলে নির্বিচারে পাপানুষ্ঠান করতে পারে না। করাল হলো খুব বেশি নিষ্ঠুর পাপাচার কর্মা হয়ে থাকে। দুর্ধর্ষ অর্থাৎ অতি প্রবল পরাক্রান্ত কুকর্মা কৌশলী হয়ে থাকেন কেহ তাদের সহজে দমন করতে পারে না। দুর্মুখ হলো দুর্বাক্য, মানুষ যখন নীতিভ্রষ্ট হয়ে যায় তখন তার আর বাক সংযম থাকে না। তিনি তখন যথোচ্ছাভাষী হয়ে মিথ্যা কুবাক্য বলতে উদগ্রীভ হয়ে উঠে। তা¤্র্য অর্থাৎ ক্রোধ। কামচরিতার্থে বিঘœ সৃষ্টি হলে ক্রোদের উদ্রেক হয় এবং তখন মানুষের মুখ প্রভৃতি তা¤্রবর্ণ ধারণ করে। অন্ধক অর্থাৎ মোহাচ্ছন্ন হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতা অন্ধ যেমন দৃষ্টিহীনতার জন্য কোন বস্তু দর্শন করতে পারে না। কামের বসে জীব হিতাহিত চিন্তা ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টি হারা হয়ে যায়। একে একে দুর্জয় অসুরা অর্থাৎ ইন্দ্রিয়বৃত্তি সকলেই মহিষাসুরের কামের পতাকা তলে সমবেত হয়। অসুরেরা সকলেই মায়াবী তারা ইচ্ছামত ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। কথায় আছে –
‘খলের ছলের অভাব নেই।’
নানারূপ ছদ্মবেশে কুপ্রবৃত্তিগুলি মানুষের অন্ত করণে প্রবেশ করে। কিন্তু মানুষ তা প্রথমে বুঝতে পারে না। আর যখন বুঝে তখন নিষ্কৃতি লাভের পথ খুঁজে পায় না। কারণ সে তখন এ অসুরদের অধীনস্থ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তামসিক বৃত্তির জন্য সাত্তি¡ক বৃত্তি দুর্বল হয়। এখানে রজোবৃত্তি যার পক্ষ অবলম্বন করে তার জয় অনিবার্য। আর এই প্রতিফলনে মায়ের প্রতিমায় রজোগুণের প্রতীক সিংহ সাত্তি¡করূপী মায়ের বাহন তমোরূপী অসুর পরাভ‚ত হলেও মায়ের চরণে তার স্থান হলো। বাম চরণে মা অসুরকে চেপে রেখেছেন।
শ্রীশ্রী দুর্গা পূজা শুধু একটি সাধারণ পূজা নয়। এটি সনাতন ধর্মের একটি বৃহৎ উৎসবও বটে। উৎসবের অর্থ হলো সার্বজনীনতা, একের অন্তরের সাথে অন্যের অন্তরের সম্পর্ক স্থাপন করা। এতে সকলের অংশগ্রহণ চাই। পূজায় পূজ্য দেবতা আর পূজক এক হয়ে যায়। কিন্তু দুর্গোৎসবে প্রতিমায় সর্বজনীনতা মন্ত্রে সর্বজনীনতা ‘তিষ্ঠ দেবী গনৈ সহঃহে দেবী’ সমস্ত দেবতার সহিত আমার মন্দিরে বিরাজ কর। পূজার বিধিতে সর্বজনীনতা দুর্গার সহিত বাহন সিংহ, লহ্মীর সহিত পেঁচা, গণেশের সহিত ইঁদুর, সরস্বতীর সহিত রাজ হংস, কার্তিকের সহিত ময়ূর এমনকি মহিষাসুরেরও অর্চনা করে থাকি। পূজার অঙ্গে দ্রব্যের সার্বজনীনতা রাজদ্বার থেকে বেইশ্যা দ্বারের মাটি (শাস্ত্রে বেইশ্যা বলতে উচ্চ মার্গের সাধিকাকে বুঝায়, মাটি বলতে তার সাধন ভুমির মাটিকে বুঝায়)। সাগরের জল থেকে গঙ্গা জল, বৃষ্টির জল, কুয়াশার জল। অনুষ্ঠানকারীদের মধ্যে সার্বজনীনতায় কুম্ভকার, পুরোহিত, নর সুন্দর, মালী, বাদ্যকার, ভুঁই মালী প্রভৃতি এমন কি পুষ্পাঞ্জলীতেও সার্বজনীনতা উঁচু, নিচু স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য সকলে একত্রে মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলী প্রদানে ধন্য হয়। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজা একটি রাজকীয় পূজা তাই সর্বজনীনতার মাঝে এখানে সঙ্গীতের বিধান দেওয়া আছে। প্রতিটি পূজায় যে সমস্ত রাগরাগিনী বাজাতে হয় তা নিম্নরূপ :
১. মালব রাগং বিজয়া বাদ্যং
২. ললিত রাগং দুন্দুভি বাদ্যং
৩. বিভাস রাগং দুন্দুভি বাদ্যং
৪. ভৈরব রাগং ভীম বাদ্যং
৫. কেদার রাগং ইন্দ্রাভিষেক বাদ্যং
৬. বসন্ত রাগং শঙ্খ বাদ্যং
৭. বসন্ত রাগং পঞ্চশব্দ বাদ্যং
৮. ধানশ্রী বাগং বিজয়া বাদ্যং
উল্লেখিত রাগ এবং বাদ্যের সঙ্গে রয়েছে মনের নিবিড় সম্পর্ক যা মানুষকে মানব থেকে দেবত্বে উন্নীত করে। তবে পূজায় সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আত্ম নিবেদন, শ্রী শ্রীমদ্ভগবদগীতায় রাজবিদ্যা রাজগুহ্য যোগে আছে।
পুত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভুক্ত্যাপহৃতমশ্মামি প্রযতাত্মন।। ৯/২৬নং
পত্র, পুষ্প, ফল, জল ভক্তির সহিত আমাকে অর্পণ করলে আমি সে সকল গ্রহণ করে থাকি। বর্তমানে প্রতিটি পূজামণ্ডপে উৎসবের নামে চলে আলোক সজ্জার বাহার। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বাদ দিয়ে চলে আত্ম মলিনকারী বিভিন্ন নাচ গান বাজনার প্রতিযোগিতা। যদিও আরতী, পূজার একটি অতি আবশ্যকীয় অঙ্গ, কিন্তু আরতী প্রতিযোগিতার নামে চলে বিদেশি ঢং এর অশ্লীল নাচ ও অঙ্গভঙ্গি।
এতে করে দেবীপূজার নামে আত্মার তমোগুণের অর্থাৎ অসুর প্রতিষ্ঠিত হয় বলেই অনেকে মনে করেন আর তাই দেশের প্রতিটি পূজারির নিকট, প্রতিটি সমাজ সচেতন ভক্ত নর-নারীর নিকট, প্রতিটি মণ্ডপের পুরোহিত মহোদয়ের নিকট বিনীত অনুরোধ, আসুন সমবেত প্রচেষ্টায় আমরা দেখি শাস্ত্র নির্ধারিত বিগ্রহে শাস্ত্র বিধিমোতাবেক পূজায় আত্ম নিবেদনে দেবীশক্তি আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এই সময়ের দুর্ভাগা জাতিকে অসুরের হাত থেকে রক্ষা করেন না কি ?
বাণী : তোমরা যাকে ব্রহ্ম বল, আমি তাকে মা বলি।
শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব
লেখক : ব্রহ্মচারী