দুনিয়াজুড়ে নতুন দুর্ভাবনা ‘ওমিক্রন”

21

পূর্বদেশ ডেস্ক

দুনিয়াজুরে নতুন দুর্ভাবনার জন্ম দিয়েছে করোনা সংক্রমণের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’, যার বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.১.৫২৯। এটির কারণে বিশ্বে নতুন করে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ভ্যারিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয়। গত শুক্রবার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টকে ‘সবচেয়ে খারাপ ও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী’ ধরন হিসেবে অভিহিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মিউটেশন ঘটেছে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টে। একে নিয়ে ভয়ের অন্যতম কারণ, কোভিড টিকার কার্যকারিতা রুখে দিতে পারে ভাইরাসের এই নতুন রূপ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে হাতে আসা তথ্য বলছে, এই ধরনটির মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ নতুন করে বিস্তারের ঝুঁকি রয়েছে। সংস্থারটির উপদেষ্টা কমিটি শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, এটি অন্যান্য উচ্চ সংক্রমণকারী ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও অধিক হারে পুনরায় সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম।
দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়ার পর বেলজিয়াম, ইসরায়েল, বতসোয়ানা এবং হংকংয়ে এটিকে শনাক্ত করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি ওমিক্রন’র সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক বার্তা প্রদান করল।
ডাব্লিউএইচও’র কোভিড-১৯ টেকনিক্যাল টিমের প্রধান মারিয়া ভ্যান কেরখোভ শুক্রবার বলেন, ওমিক্রন’কে ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ এর মধ্যে কিছু ‘বিপদজনক’ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
সন্দেহ করা হচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনও এক রোগীর শরীরে মিউটেশন ঘটে রূপটি তৈরি হয়েছে। সম্ভবত, ওই রোগী এইচআইভি আক্রান্ত। এবং তিনি বিনা চিকিৎসাতেই ছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় যত জন কোভিড সংক্রমিত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের দেহেই ওমিক্রন মিলেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন জোহানেসবার্গে। সেখানে সংক্রমিতদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া।
এদিকে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি করা করোনার ‘ওমিক্রন’ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঠেকাতে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগও স্থগিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল দুপুরে গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিষয়ে আমরা অবহিত। এই ভ্যারিয়েন্টটি খুবই এগ্রেসিভ। সে কারণে সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থগিত করা হচ্ছে। সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্টদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক পরার বিষয়েও তাগিদ দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য দেশ থেকে যারা আসবে তাদের টিকা দেয়া ও আরটিপিসিআর টেস্ট নেয়ার ব্যাপারেও জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এছাড়া এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঠেকাতে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি দেশে যাওয়া এবং সেসব দেশ থেকে প্রবেশের ওপর কড়াকড়ি ও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিশ্বের বেশ কিছু দেশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব ভালোভাবে বুঝতে আরো কয়কে সপ্তাহ সময় লাগবে। এটি কতটা সংক্রামক, তা নির্ধারণ করতে বৈজ্ঞানিকরা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যের একজন শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সতর্ক করেছেন যে, এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন ‘প্রায় নিশ্চিতভাবে’ কম কার্যকর হবে। তবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল বায়োলজিস্ট জেমস নেইস্মিথ মন্তব্য করেছেন যে, এটি খারাপ খবর বটে, কিন্তু এটিই পৃথিবীর শেষ নয়। তার মতে, এই ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনগুলো দেখে মনে হতে পারে যে এগুলো হয়তো দ্রæত ছড়ায় – কিন্তু এর সংক্রমণের সক্ষমতা বেশি, তা হয়তো এখনই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না।
প্রফেসর নেইস্মিথ মনে করেন, এই ভ্যারিয়েন্টের যদি দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা থাকতো, তাহলে এতদিনে এটি যুক্তরাজ্যে নিশ্চিতভাবে প্রবেশ করতো।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান অ্যান্থনি ফাউচি মন্তব্য করেছেন যে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে পাওয়া রিপোর্ট এটি সম্পর্কে সতর্ক করলেও তীব্র মাত্রায় অসুস্থতা ঠেকাতে ভ্যাকসিন কার্যকর হতে পারে।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাউচি বলেন, যথাযথভাবে পরীক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না এটি ভাইরাস বিরোধী অ্যান্টিবডিকে পাশ কাটাতে পারে কিনা।
ইতোমধ্যে ওমিক্রন নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর খুব কমই জানা গেছে। এই ভেরিয়েন্ট প্রসঙ্গে আফ্রিকার সেন্টার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক টুলিও ডি অলিভেরিয়া বলেন, অস্বাভাবিকভাবে এটি রূপান্তরিত হয়েছে এবং অন্য যেকোনো ভেরিয়েন্ট থেকে এটি আলাদা। তিনি বলেন, ‘এই ভেরিয়েন্টটি আমাদের হতবাক করেছে।’
ডি অলিভেরিয়া বলেন, সব মিলে ৫০ বারের মতো জিন বিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে নতুন ওমিক্রন ধরন রূপ পেয়েছে। আর এর স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য বদলেছে ৩০ বারের বেশি।
তবে এই ভেরিয়েন্টের ওপর সূ²ভাবে নজর দিলে আরেকটি বিষয় চলে আসে। ভাইরাসের যে অংশটি মানুষের শরীরের সংস্পর্শে আসে সেই রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেইন বদলেছে ১০ বার। এ পর্যন্ত চিহ্নিত সবচেয়ে সংক্রামক ডেলটা ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে এই বদল ছিল মাত্র দুবার।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, নতুন ভেরিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনের যে রূপান্তর, সেটা উদ্বেগের। কারণ, এর বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা বা টিকা নেওয়ার কারণে যে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তা কাজ করবে কি না। তবে ইতালির শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট রবার্তো বুরিওনি বলেন, জনসাধারণের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত হবে না। টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, এই ভেরিয়েন্ট নিয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এইধরনের রূপান্তর একজন রোগীর শরীরেই সম্ভব, যিনি কি না এই ভাইরাস থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তবে আশার কথা হলো, মিউটেশন বা রূপান্তর মানেই খারাপ কিছু নয়। মিউটেশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভাইরাসের কোন ধরনের রূপান্তর হচ্ছে।
কিন্তু বিজ্ঞানীদের উদ্বেগের জায়গাটি ভিন্ন। সেটি হলো, নতুন এই ভেরিয়েন্ট চীনের উহানে শনাক্ত স্ট্রেইনের চেয়ে আলাদা। কিন্তু যেসব টিকা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো মূলত ভাইরাসের মূল স্ট্রেইনের ওপর ভিত্তি করে। ফলে, এমনটা হতে পারে যে নতুন এই ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকা কাজ করছে না।
ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। গবেষণাগার থেকে এর একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে। কিন্তু যেসব প্রশ্ন উঠছে, তার সত্যিকারের উত্তর পাওয়া যাবে আসলে সংক্রমিত রোগীর পর্যবেক্ষণ করে।