দুদকের গণশুনানীর উদ্যোগ প্রশংসিত দুর্নীতি দমনে আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে

20

গত বছরখানেক আগে সম্ভবত সুইস ব্যাংকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত ইস্যুতে করা একটি রিট আবেদনের শুনানিকালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্পর্কে উচ্চ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ মন্তব্যের কথা স্মৃতিতে ভেসে আসে। আদালতে বলেছিলেন, ‘দুদককে দন্তহীন বাঘ হলে চলবে না। দুদককে কনসার্ন হতে হবে সুইস ব্যাংকের জব্দ টাকা ফেরত ইস্যুর বিষয়ে।’ আমরা জানি, দুদকের এক সাবেক চেয়ারম্যান নিজেই এ কমিশনকে ‘দন্তহীন বাঘ’ বলেছিলেন একাধিকবার। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সে অবস্থার কতটা পরিবর্তন হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে এটা ঠিক, সা¤প্রতিককালে দুদককে দুর্নীতির ব্যাপারে আগের চেয়ে বেশি তৎপর হতে দেখা গেছে। বিভিন্ন অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি করছে সংস্থাটি। কয়েকবছর ধরে সংস্থাটি সরকারি, বেসরকার, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ অধিদপ্তরের আওতায় থাকা সকল অফিসের বিরুদ্ধে কারো অভিযোগ থাকলে তা উন্মুক্তভাবে গ্রহণ ও শুনানীর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। তাৎক্ষণিক অভিযোগের নিস্পত্তিসহ গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্তের ব্যবস্থাও করছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে এ ধরনের গণশুনানী অনুষ্ঠিত হয, এতে ২২টি সংস্থার বিরুদ্ধে ২শতাধিক অভিযোগ জমা হয়। শুনানী হয় ৪৭টির। তাৎক্ষণিকভাবে মীমাংসা হয় ৩০টি বাকিগুলো তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। গণশুনানীতে সরকারিম, বেসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাসমুহের প্রধানসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রামে এধরনের শুনানী আগেও হয়েছে। দুদকের শুনানী এবং তাৎক্ষণিক অভিযোগের মীমাংসার উদ্যোগে ভুক্তভোগীরা সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমকে। এছাড়া দুদকের ফাঁদ-টিমের কার্যক্রম ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে অনেক দুর্নীতিবাজকে এমনকি সরকারি দলের পরিচয়ে নানা অপরাধের সাথে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গকেও ধরতে সক্ষম হয়েছে দুদক। তবে এই সুনামকে পুঁজি করে দুদকের কোনো কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন-এমন অভিযোগও উঠেছে। তা ছাড়া অর্থ পাচারসহ ব্যাংক চ্যানেলে সম্পাদিত অনেক বড় বড় দুর্নীতি রোধ করতে পারেনি দুদক। এ ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। এ জন্য দুদককে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে দুদক আইনে আনতে হবে সংশোধনী। অতীতে দুদকের কর্মকাÐ দেখে এ কমিশনকে কাগুজে বাঘ মনে হয়েছে। আমরা দেখেছি হলমার্ক, ডেসটিনির মতো প্রতারণার ঘটনায় দুদকের কঠোর হুঁশিয়ারির পরপরই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে অপরাধীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। আমরা দুদককে নখদন্তযুক্ত হিং¯্র কিংবা নখদন্তহীন কাগুজে বাঘ-এ দুয়ের কোনো রূপেই দেখতে চাই না। আমরা চাই, দুদক একটি সংবিধিবদ্ধ মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসাবে দুর্নীতি দমনে সুষ্ঠু ভূমিকা পালনকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করুক। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারকেও সত্যিকারের সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে দুদককে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
দুদক যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে-তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি দেশের অন্যতম বড় সমস্যা এখন। এমন সরকারি, স্বায়ত্বশাসত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা কঠিন, যেখানে দুর্নীতির চর্চা হয় না। বস্তুত, দেশে যে দুর্নীতি হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে অথবা কান পাতলেই তা স্পষ্ট হয়। প্রায় প্রতিদিনই দুর্নীতির কোনো-না-কোনো খবর প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। দুর্নীতির এসব খবরের কিছু আবার বড় আকারের অভিযোগ। ব্যাংক সেক্টরের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর জেনেছে দেশবাসী। প্রকল্পের কেনাকাটাসহ বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি সর্বজনবিদিত। নিয়োগ-বাণিজ্য ওপেন-সিক্রেট বলা যায়। কাজেই দুর্নীতি রোধে দুদককে পর্যাপ্ত ক্ষমতাসম্পন্ন করার বিকল্প নেই। দুদককে যথার্থই একটি স্বাধীন ও দুর্নীতি দমনে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা জরুরি। তবে আমরা মনে করি, এককভাবে দুদকের পক্ষে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হবে না, কিছুটা প্রতিরোধ করা যাবে হয়তো। বস্তুত, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত সমাজে পরিণত করতে হলে সর্বদিকবিস্তৃৃত পদক্ষেপ ¯্রহণ করতে হবে। রাজনীতিতে শুদ্ধাচার ও নৈতিকতা ফিরিয়ে আনা সেসব পদক্ষেপের একটি।
রাজনীতিই যেহেতু পরিচালনা করে দেশের সাম¯্রকি কর্মকাÐ, সেহেতু রাজনীতিতে ন্যায়-নীতি, আদর্শ না থাকলে সাধারণ মানুষও নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শহীন হয়ে পড়তে পারে। আমরা এও জানি সরকার ২০১২ সালে যে শুদ্ধাচার কৌশলপত্র গ্রহণ করেছে তার মূলেই ছিল দুর্নীতি বন্ধ করে সুশাসন নিশ্চিত করা। সরকার কৌশলপত্র বাস্তবায়নে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই দুর্নীতি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে কমেনি। আশা করা যায়, দুদকের সম্প্রতি কর্মকাÐ দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও টানা যাবে।