দুদকের করা ২০ বছর আগের মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন সবাই

28

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘটনা ২৫ বছর আগের। আর মামলা ২০ বছর আগের। দুর্নীতির মামলা। আসামিদের মধ্যে উপরের সারিতে ছিল চট্টলবীর প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামও। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালে মুরাদপুরে চসিকের দোকান বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতাসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে করা ২০০২ সালে দুদকের ওই মামলায় সব আসামিকেই শেষতক অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। এসময় অভিযুক্তদের মধ্যে ১৫ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আব্দুল মজিদ এ আদেশ দেন।
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাড. শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী জানান, দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলায় চার্জশিটভুক্ত ২০ আসামির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই তদন্ত কর্মকর্তা প্রমাণ করতে পারেননি। এ বিষয়টি আমরা আদালতের কাছে তা প্রমাণ করতে পারায় আদালত সম্পূরক চার্জশিটভুক্ত সব আসামিকেই বেকসুর খালাস দিয়েছেন। যদিও অভিযোগপত্রভুক্ত ২৪ আসামির বিরুদ্ধে কে এম সিরাজ উদ্দিন, হাফেজ আহমদ ও খায়রুল আনোয়ার মৃত্যুবরণ করায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন জানানো হয়। মারা যাওয়ায় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে মামলার দায় থেকে ২০১৮ সালের ৩০ মে অব্যাহতি দেয় আদালত। পরে গতকাল ২০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের দিন সবাইকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশ দেন আদালত।
প্রসঙ্গত, মুরাদপুরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্মিত ২৩টি দোকান ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়। পত্রিকায় টেন্ডার ও যাচাই-বাছাই ছাড়া দোকানগুলো বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগে ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করে দুদক। দুদকের তৎকালীন পরিদর্শক সামছুল আলম বাদি হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ ২৪ জনকে আসামি করা হয়। মামলার বাদি প্রথমে আদালতে সাক্ষ্য স্মারক জমা দেন। পরে সামছুল আলম বদলি হলে মামলাটি দুদকের আরেক পরিদর্শক মো. মবিনুল ইসলাম তদন্ত করে তিনিও আদালতে সাক্ষ্য স্মারক জমা দেন। মৃত্যুবরণ করায় প্রধান আসামি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, কেবিএম সিরাজ উদ্দিন, হাফেজ আহমদ ও খায়রুল আনোয়ারকে আগেই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
আদালতের আদেশে মামলা থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্তরা হলেন সুগন্ধা আবাসিক এলাকার মো. জাহেদুল আলম চৌধুরী, পাঁচলাইশের খোরশেদ আলম চৌধুরী, গরীবউল্লাহ শাহ হাউজিং সোসাইটির বখতিয়ার উদ্দিন খান, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির এএম মাইনুল হক ও তার স্ত্রী নাজনীন সুলতানা, চাঁনমারী রোড এলাকার মোবারক উল্লাহ, পাঁচলাইশ থানা এলাকার নেজামুল হক, মুরাদপুর এলাকার হোসনে আরা বেগম, হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ মুহুরী বাড়ির মো. ইউনুস, মুরাদপুর পিলখানা এলাকার শেখ সরওয়ার্দী, দামপাড়া এলাকার ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী, লোহাগাড়ার চুনতি মুন্সেফ বাজার সিকদার পাড়ার মো. এরশাদুল হক, পূর্ব নাসিরাবাদের হাসিনা ভূঁইয়া, ওআর নিজাম রোডের মেহেদীবাগের নুর নাহার বেগম, কোতোয়ালী থানা এলাকার হাসান মুরাদ, পাঁচলাইশ থানাধীন খতিবের হাট এলাকার দিদারুল ইসলাম, এনায়েত বাজার এলাকার মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, পটিয়ার মুন্সেফ বাজারের গোলশান বেগম, বাকলিয়ার আঞ্জুমান আরা বেগম মিনু ও ফেনী সদর থানার শিলুয়া গ্রামের মাহবুব মিন্টু।
দুদক কর্মকর্তা মবিনুল ইসলামের সাক্ষ্য স্মারকে উল্লেখ করা হয়েছিল, সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী উক্ত দোকান ইজারা সংক্রান্ত পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেননি। প্রতিটি আবেদনপত্রের ওপর নিজের মনগড়া দোকানের মূল্য ও মাসিক ভাড়া নির্ধারণপূর্বক লিখিত বরাদ্দ আদেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে আরেক পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম আগের দুই তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য স্মারক পর্যালোচনা করে ২০০৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিল করেন।
এরপর মহিউদ্দিন চৌধুরীর রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০০৬ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি মামলাটির কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ দেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর রিট পিটিশন সংক্রান্ত রুল খারিজ করে দিয়ে মামলার কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন হাইকোর্ট। এরপর মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট আদালত। আদালতের নির্দেশে দুদক প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগপত্রে কেবিএম সিরাজ উদ্দিন, হাফেজ আহমদ ও খায়রুল আনোয়ার মৃত্যুবরণ করায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন জানানো হয়। সম্পূরক চার্জশীটভুক্ত ২০ জন আসামি মূল সুবিধাভোগী হিসেবে ২০টি দোকানের পজিশন গ্রহণ করে ১৯৪৭ সালের ২নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অপরাধের সাথে পরস্পর যোগসাজশে দন্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল।
আদালতে জমা দেয়া অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, নগরীর মুরাদপুর যাত্রী ছাউনিতে কিছু দোকান নির্মাণ করা হয়। নির্মিত ২৩টি দোকান বরাদ্দ কিংবা ভাড়া প্রদানের জন্য চসিক পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেনি। কোনো নোটিশও ঘোষণা করা হয়নি। ২৩ জন যাত্রী ছাউনির দোকান বরাদ্দ প্রাপ্তির আশায় তৎকালীন মেয়রের বরাবরে সাদা কাগজে সরাসরি আবেদন করেন।
মেয়র দোকানগুলো ভাড়া কিংবা ইজারা প্রদান সংক্রান্ত কোনো দাম কিংবা নীতিমালা তৈরি না করেই, কোনো কমিটি না করেই, নিজেই প্রতিটি দরখাস্তের ওপর দোকানের মনগড়া দাম উল্লেখ করে দোকান বরাদ্দ প্রদান করেন। পত্রিকায় দরপত্র প্রকাশের মাধ্যমে দোকানসমূহ বরাদ্দ প্রদান করা হলে, অধিক মূল্যে এবং অধিক হারে মাসিক ভাড়ায় দোকানগুলো বরাদ্দ প্রদান সম্ভব হতো। এ ক্ষেত্রে মেয়র ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক নিজে লাভবান হওয়ার জন্য এবং অন্যকে লাভবান করার উদ্দেশে মুরাদপুর যাত্রী ছাউনিতে নির্মিত ২৩টি দোকান বরাদ্দ প্রদান করে চসিকের ক্ষতিসাধন করেন বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু আদালতের কাছে দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্রের অনুক‚লে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয় দুদক। সেকারণে সব আসামিকেই খালাস দেয়ার আদেশ দেন আদালতের বিচারক। এর মধ্যদিয়ে ২০ বছর ধরে চলমান এ মামলার সমাপ্তি ঘটল।