দুই শিশুর অটিজম জয়ের গল্প

277

ওয়াসিম আহমেদ

বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান অদ্রিজয় বিশ্বাস। চার বছর বয়সে স্পষ্ট হতে থাকে অটিস্টিক শিশুর সবক’টি লক্ষণ। পরিবারকে আলোকিত করে পৃথিবীতে আর্বিভাব হলেও হয়ে ওঠে দুশ্চিন্তার কারণ। চারপাশের তীর্যক মন্তব্য আর আজগুবি প্রশ্নে জীবন বিষিয়ে ওঠেছিল অদ্রিজয়ের মা অনামিকা বিশ্বাসের। তবুও হাল ছাড়েননি। উপযুক্ত পরিবেশ, ধৈর্যের সাথে চর্চা আর চিকিৎসায় অদ্রি এখন সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুদের সাথে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
এ যেন যুদ্ধ জয়ের গল্প। কথা হয়, অনামিকা বিশ্বাসের সাথে। তিনি পূর্বদেশকে জানান, ‘অদ্রিজয় বিশ্বাস আমাদের একমাত্র সন্তান। তাকে নিয়ে আমাদের এই লড়াই এখনো চলছে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সে আজ মূলধারার স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে পড়ছে। প্রথম যখন আমরা বাবা-মা হলাম সে এক অনাবিল আনন্দ আমাদের চোখে মুখে। আমরা সেই নবজাত সন্তানকে নিয়ে নুতন নুতন সপ্নের জাল বুনেছি। সেই স্বপ্ন ভাঙতে বেশি দিন সময় লাগেনি আমাদের। যখন ৪ বছর বয়স তখন আমরা বুঝতে পারি ও আর দশটা সাধারণ বাচ্চার মত নয়। ডাক্তার দেখানোর পর আরও নিশ্চিত হই। কিছু ওষুধ দিয়ে বিশেষ শিশুর স্কুলে ভর্তি করাতে বললেন। চট্টগ্রামের নিষ্পাপ অটিজম স্কুলে ভর্তি করালাম। ধীরে ধীরে পজেটিভ লক্ষণ দেখতে পেলাম।’
অনামিকা বিশ্বাস নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘স্বাভাবিক বাচ্চা প্রতিপালনের প্রচলিত পদ্ধতি এখানে কাজ করে না। তারা সমাজ পরিবার সব কিছুর নুতন রূপ দেখতে পায়। কিছু কিছু মানুষ এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন আমাদের বাচ্চাগুলো ভিন্গ্রহের প্রাণি। কিছু মানুষ ‘আজগুবি’ ‘আজগুবি’ প্রশ্ন করে মা-বাবার কষ্টগুলোকে আরও বাড়িয়ে দেয়। শুরু হয় দোষ খোঁজা এবং উপদেশের বন্যা। তাই আমাদেরকে বাচ্চার অসুস্থতার সাথে লড়াই করার পাশাপাশি বিরুদ্ধ সমাজের সঙ্গেও লড়তে হয়। আমি জানি এই অভিজ্ঞতা কমবেশি সবার আছে। আমাদের অদ্রির অনেক খাবারে নিষেধ ছিল। ও যা খেতে পারত না আমরা ওই সব খাবার ঘরে আনতাম না। আমরাও খেতাম না। এখনো আমরা বাচ্চার খাওয়া দাওয়া নিয়ে অনেক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখি। অটিস্টিক বাচ্চার মা-বাবার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হল ধৈর্য। এই পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে কিছুই হবে না।’
এমনই অটিজমকে জয় করা আরেকজন মা হলেন তপা দাশ। তার প্রথম সন্তান স্বর্নবও ছিল অটিজমে আক্রান্ত। সে এখন পটিয়া শশাংকমালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণিতে পড়ে। যে ছেলের মুখে মা ডাক শুনার জন্য হাহাকার করেছি। সে আজ আমাদেরই প্রশ্নের ফাঁদে ফেলে দেয়। এটাই অর্জন। সন্তানের অটিজম ধরা পড়ার পর নিষ্পাপে ভর্তি করাই। তারা শুধু স্বর্নবকে সুস্থ করে তুলেননি, আমাকেও প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন। অটিস্টিক শিশুকে সুস্থ করার একমাত্র ওষুধ সুস্থ ও অনকূল পরিবেশে তাকে স্বাভাবিক করে তোলা। এখানে মা-বাবার প্রশিক্ষিত হওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন। নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে পূর্বদেশকে এমনটা জানান তপা দাশ।
কাল শনিবার বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২ এপ্রিল দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে।
অটিজম কি? অটিজম একটি মানসিক রোগ যা বিশেষত বাচ্চাদের মধ্যে পাওয়া যায়। অটিজম আক্রান্ত শিশুরা অন্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা আচরণ করে, যেমন বারবার একই জিনিস পুনরাবৃত্তি করা। এই রোগ সাধারণত এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। কিভাবে বুঝবেন শিশু অটিজমে আক্রান্ত? যদি দেখা যায়, ৬ মাস বয়সের মধ্যে শিশু একা একা না হাসে, ১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো কথা বলতে পারছে না, পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা করছে না, ১৬ মাসের মধ্যে কোনো একটি শব্দও বলতে পারে না, ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারার পর আবার ভুলে যাচ্ছে এবং বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করছে না। এসব লক্ষণ দেখা গেলে তখন তাকে অবশ্যই অটিজমের বৈশিষ্ট্য আছে কি না বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
সামাজিক সচেতনতাবোধ ও ভাবের আদান-প্রদান মস্তিষ্কের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, বিশেষ শিশুদের সেই অংশের বিকাশ সঠিকভাবে ঘটে না। তাই বয়স বাড়তে থাকলেও অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্য শিশুদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। তারা সমাজের স্বাভাবিক স্রোতে যুক্ত হতে পারে না। তাদের সামলাতে হিমশিম খান মা-বাবারাও। সামাজিক সচেতনতা, সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সুস্থ হয়ে উঠে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা। তাই প্রথমত পরিবারকে মেনে নিতে হবে এবং সমাজকে স্বাভাবিকভাবে এসব শিশুদের গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই সমাজের বোঝা না হয়ে স্বাভাবিক অংশ হয়ে উঠবে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা। এমনটা মনে করেন অটিজম বিশেষজ্ঞরা।
অটিজম রয়েছে এমন শিশুর মধ্যে মূলত দুই ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়: সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে অসুবিধা এবং আশপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা, বারবার একই ধরনের আচরণ করা।
নগরীতে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মূল স্রোতে ফেরাতে ও স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে লড়াই করছে নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন। ইতোমধ্যে অটিজম উত্তরণে জাতীয় সম্মাননা পুরস্কারও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রবর্ত্তক সংঘ হতে ভাড়াকৃত ভবনে ৮০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে দুই শিফটে ১:১, ক্ষেত্র বিশেষে ১:২ পদ্ধতিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এমন প্রশিক্ষণ বছরব্যাপী চলমান থাকে। প্রশিক্ষণে যেসব শিশুর উন্নতি হয়, তাদের স্বাভাবিক শিশুদের সাথে সমন্বিত স্কুলে পড়ানো হয়। এভাবে তারা স্বাভাবিক হয়ে উঠে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৫৭ জন শিশু স্বাভাবিক স্কুলে পড়াশোনা করছে। ফাউন্ডেশনের দাতা সদস্য এবং চিত্ত ও বিত্তশালী সমাজ অনুভাবকদের সহযোগিতায় ফতেয়াবাদে নিজস্ব ভ‚মির উপর নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ কাজ শুরুর প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকদের ক্যারিয়ার নিশ্চিয়তা দিতে তাদের এমপিওভুক্ত করার সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার জানান, অটিজম নিয়ে আগের তুলনায় অনেক সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু সুযোগ বরাবরই সীমিত। তাই নিষ্পাপ অটিজম স্কুলকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। নিষ্পাপ অটিজম স্কুলের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের ১নং ওয়ার্ডে ডা. আর.পি সেনগুপ্ত নিষ্পাপ সমন্বিত বিদ্যালয় করা হয়েছে। যাতে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা পরিচর্যার পর স্বাভাবিক শিশুর সাথে পড়াশোনার চর্চায় স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। তারা গ্রামাঞ্চল থেকে আসে, অনেকেই শহরের স্কুলে পড়ানোর সুযোগ পায় না। তাদের কথা মাথায় রেখে আমরা স্থায়ী কার্যালয়ে তিনটি ফ্লোর আবাসিক চর্চাকেন্দ্র করতে যাচ্ছি। যেখানে অভিভাবকরা অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত থাকতে পারবেন। শিশু স্বাভাবিক হলে বা অভিভাবক অটিজম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি শিখে যাওয়ার পর চলে যেতে পারবেন। এতে অভিভাবক নিজে দক্ষ হয়ে উঠলে গ্রামে থেকেও শিশুর অটিজম রোগ সারিয়ে তুলতে পারবেন।