দুই দিনের মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক হতে পারে

41

ফারুক আবদুল্লাহ

নতুন দাম সমন্বয়ের দুই দিন পরও বাজারে ভোজ্যতেল মিলছে না। রীতিমতো বাজার থেকে তেল উধাও হয়ে গেছে। ভোজ্যতেল সরবরাহ ঘাটতির পিছনে কোম্পানিগুলোর কারসাজি ঢাকার চেষ্টা চলছে।
মিল মালিক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে বাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ঈদের পর বাজারে তেলের সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। মঙ্গলবারের দিকে সংকট কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের মজুতকরণ ও সিন্ডিকেট না থাকলে আরও কম দামে মানুষ তেল কিনতে পারত।ডিলাররা বলছেন, রোববার (আজ) ব্যাংক খোলার পর সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। তবে বাজারে পাম তেল সরবরাহ থাকলেও ডিলাররা নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে সয়াবিন, পাম অয়েলের যে দর নির্ধারণ করে দেয়, তা একটি মহলের পছন্দ নয়। তাদের দাবি, ব্যবসায়ীরা নিজেরাই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে সয়াবিন, পাম অয়েলের দর নির্ধারণ করবেন।
গত বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দিলে এই সুযোগটি নেয় একটি চক্র। তারা বাজার থেকে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল উধাও করে দেয়। রাতারাতি হু হু করে দাম বাড়তে থাকে সয়াবিন তেল, পাম অয়েলের। অনেকটা বেকায়দায় পড়ে যায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন ভোক্তারা।
পরে বাধ্য হয়ে গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের নতুন দর নির্ধারণ করে। এদিন বিকেলে সংগঠনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বোতলজাত পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে ৩৮ টাকা। আগে প্রতি লিটারে বোতল সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৬০ টাকা। এখন তা কিনতে হবে ১৯৮ টাকায়। এছাড়া, খোলা প্রতি লিটার পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ১৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮০ টাকা। আর বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৭৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফেকচার অ্যাসোসিয়েশনের ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতি লিটার পরিশোধিত খোলা পাম সুপার তেল এখন থেকে ১৩০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭২ টাকায় বিক্রি হবে।
তবে নতুন যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে দেশের বাজারে তেলের দাম বেশি। তেল সিন্ডিকেটের দাবি অনুযায়ী নতুন এ দর নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে গত ২০ মার্চ ভোজ্যতেলে দাম সমন্বয় করা হয়। তখন বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৮ টাকা কমানো হয়। এছাড়া, খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৬ টাকা ও পাম তেলের দাম লিটারে ৩ টাকা কমানো হয়। এর আগে, সরকার ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে শুল্ক প্রত্যাহার করে।
তেলের বাজারের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের আর এম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার আলমগীর পারভেজ বলেন, এখন কোম্পানি পর্যাপ্ত মাল সরবরাহ দিচ্ছে। আজ (শনিবার) মিল থেকে তেল নিয়ে খাতুনগঞ্জে ট্রাক ঢুকেছে। এতে আগের তুলনায় সরবরাহ বাড়ছে। আশা করি আগামী মঙ্গলবারের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
পুষ্টির ডিলার এস এন্ড এস ব্রাদার্সের ম্যানেজার মো. রফিক বলেন, মালের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় বাজারে সংকট চলছে। তবে পুষ্টি যেভাবে মাল সরবরাহ করেছে, সেভাবে যদি সবাই সরবরাহ করত এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। রবিবার (আজ) থেকে ব্যাংক খুলছে, এইদিন কোম্পানি থেকে মাল আসার কথা রয়েছে। তাছাড়া আমরা কোম্পানি থেকে যা পাচ্ছি তাই বাজারে সরবরাহ করছি।
চাক্তাই এলাকার ভোজ্যতেলের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা মোহাম্মদ আলীম বলেন, ভোজ্যতেল পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করি আমরা। প্রতিদিন প্রচুর ভোজ্যতেল বিক্রি করে থাকি। তবে এখন দাম বাড়তি। সরবরাহ বাড়ানো হলে বাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৩ লাখ টন পাম তেল আমদানি হয়। যার ৯০ শতাংশই আমদানি হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। মালয়েশিয়া থেকে আমদানি হয় বাকি ১০ শতাংশ।
গত বছর বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ টন সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসে গড়ে এক লাখ ৫০ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে পর্যাপ্ত সয়াবিন তেলের মজুত আছে। আমদানিকারকরা একই কথা বলছেন। সয়াবিন তেলের ৯৪ ভাগই আনা হয় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে। এই তেল প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন মনে করেন, কয়েকজন ভোজ্যতেল আমাদানিকারকের হাতে জিম্মি হয়ে আছে ভোক্তারা। এসব আমদানিকারক সরকারকে চাপ দিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তারা এই কাজ করেছে। এখন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপরও পড়বে।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ৪৭ হাজার ৪৪ টন পাম ও সয়াবিন তেল নিয়ে পৌঁছেছে ৪টি জাহাজ। ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত এসব তেল চট্টগ্রাম বন্দর এসে পৌঁছে।
বন্দরের তথ্য মতে, ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনা থেকে চারটি জাহাজ ৪৭ হাজার ৪৪ টন ভোজ্যতেল নিয়ে চট্টগ্রামে বন্দরে এসেছে। এর মধ্যে ওরিয়েন্ট চ্যালেঞ্জের খালাস শেষ হয়েছে। আর বাকি তিনটি জাহাজের তেল খালাস প্রক্রিয়া চলছে।
এর মধ্যে ২১ হাজার টন তেল নিয়ে ওরিয়েন্ট চ্যালেঞ্জ, ৭ হাজার টন নিয়ে এন এস স্টিলা, ৭ হাজার ৭৯৯ টন নিয়ে এমটি প্রাইড ও ১১ হাজার ২৪৫ টন নিয়ে সানজিন জাহাজ বন্দরে এসেছে। ওরিয়েন্ট চ্যালেঞ্জ ও এন এস স্টেলা নামে দুটি জাহাজে আর্জেন্টিনা থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আনা হয়েছে। এমিটি প্রাইড ও এম টি সানজিন নামে বাকি জাহাজ দুটি ইন্দোনেশিয়া থেকে অপরিশোধিত পাম তেল নিয়ে এসেছে। এস আলম গ্রæপ, সিটি গ্রæপ, বসুন্ধরা, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, মেঘনা গ্রæপ ও সেনা কল্যাণ এ তেল আমদানি করেছে বলে জানা গেছে।