দুই ট্যাংক যখন ডুবে একাকার পানি ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে

26

এম এ হোসাইন

বর্ষার শুরুতেই কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় প্লাবিত হয় নগরীর অনেক এলাকা। এ সময় বাইরের ময়লা ও দুর্গন্ধময় পানি প্রবেশ করেছে অনেক বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার (পানির ট্যাক) ও সেফটিক ট্যাংকে। জমা পানি নেমে যাওয়ার পর আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকছে আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভারে। পানির মাধ্যমে এসব জীবাণু প্রবেশ করতে পারে মানুষের শরীরে। তাই রিজারর্ভার যথাযত পরিষ্কার (জীবাণুমুক্তকরণ) করে পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
আষাঢ়ের শুরুতেই টানা বৃষ্টিতে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এমনকি টানা এক সপ্তাহ পর্যন্ত পানি আটকে থাকে নগরীর বিভিন্ন নি¤œাঞ্চলে। এখান থেকে পানি প্রবেশ করে বাসাবাড়ির নিচতলা, দোকানপাঠে। প্রায় বাড়ির নিচেই আছে আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার ও সেফটিক ট্যাংক। ফলে বাইরে জমে থাকা ময়লা পানি প্রবেশ করেছে এসব রিজার্ভার ও সেফটিং ট্যাংকে। মিশ্রিত এসব পানির কারণে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে রিজার্ভার।
বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ায় এখন অনেকে রিজার্ভার থেকে পানি নেওয়া শুরু করে দিয়েছেন। যথাযথ উপায়ে রিজার্ভার পরিষ্কার করা না হলে সেখান থেকে জীবাণু ছড়াতে পারে। রিজার্ভার পরিষ্কার ও বিশুদ্ধকরণের মাধ্যমেই পানি পান করতে হবে। অন্যথায় পানিবাহিত রোগ হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানায় চট্টগ্রাম ওয়াসা। পানির রিজার্ভার পরিষ্কার ও নিরাপদ করতে সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে ওয়াসার সহযোগিতা নেয়ার অনুরোধও জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট জলজটে বহু মানুষের ঘরবাড়ির নিচতলায় পানি প্রবেশ করেছে। সেফটিক ট্যাংক ও ঘরের পানির আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভারে পানি প্রবেশ করেছে। বাইরের ময়লা-দুর্গন্ধময় পানি ঘরের পানির রিজার্ভারে প্রবেশ করে। তাই পানি নেমে যাওয়ার পর রিজার্ভার সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরাপদ করতে হবে। তাছাড়া এই সময়ে পানি ভালোভাবে সিদ্ধ করে পান করা উচিত। না হয়, এই সময়ে এসে অনেকের ডায়রিয়া বা পানিবাহিত রোগ দেখা দিতে পারে।
চট্টগ্রাম ওয়াসা শতভাগ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের পানি শতভাগ বিশুদ্ধ। কিন্তু গ্রাহকের বাড়ির পানির রিজার্ভারের দায়িত্ব আমরা নিতে পারবো না। সেটা যদি অনিরাপদ হয়, তাহলে বিপদ হতেও পারে। তাই গ্রাহকের পানির রিজার্ভার পরিষ্কারে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা সচেতনতা তৈরির জন্য লিফলেট ও বিজ্ঞাপন প্রচার করছি। গ্রাহকের পানির ট্যাংক নিরাপদ করার জন্য কোনো পরামর্শের প্রয়োজন হলে সহযোগিতা করবো। কোনো অবস্থাতেই বাইরের পানি প্রবেশ করা রিজার্ভার পরিষ্কার না করে পানি পান করা উচিত হবে না।
এদিকে রিজার্ভার পরিষ্কারে গ্রাহকদের সচেতনতার উপর জোর দিয়ে ওয়াসা লিফলেট বিতরণ ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওয়াসার বিজ্ঞাপনে বলা হয় ‘সম্প্রতি অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে চট্টগ্রাম শহরের কিছু এলাকয় ভূ-গর্ভস্থ জলাধারের পানি প্লাবনের পানিতে মিশ্রিত হয়ে পান ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে সম্মানিত গ্রাহকগণকে তাদের বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড ও ওভারহেড রিজার্ভার পরিষ্কারকরণ (জীবাণুমুক্তকরণ) এবং পানি ফুটিয়ে পান করার অনুরোধ করা হচ্ছে।’
একই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘রিজার্ভার পরিষ্কার প্রক্রিয়া জানার জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার মড-১ ফোন: ০২৩৩৩৩২৫২৫২), মড-২ ফোন: ০২৩৩৩৩৫৬৫৯২, মড-৩ ফোন: ০২৪১৩৮৮০০৬) এবং মড-৪ ফোন: ০২৩৩৩৩৫৬৭৬৮) বিভাগ সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করবে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, আমাদের দায়িত্ব পানি শোধনাগার থেকে গ্রাহকের ঘরের মিটার পর্যন্ত। তারপর গ্রাহক সে পানি যেখানে রাখছেন সেটার দায়দায়িত্ব পুরোটাই গ্রাহকের। আমাদের পানি আইএসও স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী। এখন বৃষ্টির সময়, গ্রাহকদের বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। গ্রাহকের বাড়ির পানির ট্যাংকে যাতে পানি প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য ভালোভাবে বন্ধ করে রাখতে হবে। তারপরও পানি প্রবেশ করলে যথাযথভাবে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধকরণ করেই পানি পান করতে হবে।
গ্রাহকের ঘরের পানির রিজার্ভার পরিষ্কার বিষয়ে পরামর্শ নিতে ওয়াসায় যোগাযোগের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, সচেতনতা বাড়াতে আমরা বিজ্ঞাপন দিচ্ছি, লিফলেট বিতরণ করছি। তারপরও যদি গ্রাহকের এ বিষয়ে পরামর্শের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাদের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা পরামর্শ দিবেন। সঠিক উপায়ে পানির ট্যাংক পরিষ্কার করার মাধ্যমে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে গত ৬ মার্চ এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি পরীক্ষা করতে চার সদস্যের কমিটি গঠনের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটির প্রধান করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিনকে। সদস্য হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জোবাইদুল আলম, বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) প্রতিনিধি ড. দীপংকর চক্রবর্তী এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম গবেষণাগারের উপ-পরিচালক মো. কামরুল হাসান।
কমিটিকে পানি পরীক্ষা করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এরই মধ্যে কমিটি সভা করে নমুনা নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার ২৪টি স্পটকে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি পানি শোধনাগার, পাঁচটি রিজার্ভার, ১০টি বিতরণ পয়েন্ট এবং চারটি গ্রাহক পয়েন্ট রয়েছে। ১৩ জুন থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি পরীক্ষার কাজ শুরু করেছে বিশেষজ্ঞ টিম। পানিতে কোনো সমস্যা আছে কি-না তা দেখতে ২৪টি পয়েন্টের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ল্যাবে পানির নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জোবাইদুল আলম বলেন, আগে আমরা সব পয়েন্টের নমুনা সংগ্রহ শেষ করবো। এরপর পরীক্ষা করেই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিব।