দুই চুলা ২১০০ টাকা করার প্রস্তাব, ব্যবসায়ীদের ‘না’

20

ঢাকা প্রতিনিধি

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাসের দামবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। আবাসিকে ব্যবহৃত গ্যাসের দামবৃদ্ধির এ প্রস্তাবে দুই চুলার মাসিক বিল দুই হাজার ১০০ টাকা এবং এক চুলার দুই হাজার টাকা করার কথা বলা হয়। বর্তমানে দুই চুলার মাসিক বিল ৯৭৫ টাকা ও এক চুলার বিল ৯২৫ টাকা। এছাড়া শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা এবং ক্যাপটিভে (শিল্প-কারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস) ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে ৩০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।
এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের একটি পক্ষ প্রস্তাবের পক্ষে মত দিলেও অপর পক্ষের মত নেতিবাচক। এছাড়া গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকেই।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি) ভর্তুকি সামাল দিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। একাধিক গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার গড়ে ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৯ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা ৩৫ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণকারী ছয়টি কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে তিতাস, বাখরাবাদ ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিসহ চারটি কোম্পানি আলাদাভাবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) এই প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এই সপ্তাহে বাকি দুটি কোম্পানিও তাদের প্রস্তাব জমা দেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভর্তুকির চাপ সামলাতে গত বছরের ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল। এরপর ৩ জানুয়ারি জ্বালানি বিভাগ গ্যাসের দামবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠাতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেয়। আমদানি করা এলএনজি ও দেশীয় গ্যাসের দাম, ভ্যাট-ট্যাক্স, বিভিন্ন তহবিলের চার্জ ধরে একটা খসড়া হিসাব পেট্রোবাংলা থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলোতে পাঠানো হয়। এরপর বিতরণ কোম্পানিগুলো নিজেদের আয়-ব্যয় হিসাব উল্লেখ করে দামবৃদ্ধির প্রস্তাব কমিশনে পাঠায়। একই সঙ্গে কোম্পানিগুলো নিজেদের পরিচালন ব্যয় (মার্জিন) বৃদ্ধিরও প্রস্তাব দিয়েছে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, এ পর্যন্ত চারটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি দরবৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তথ্যের ঘাটতি থাকায় আরো তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে। কমিশনে প্রস্তাব পাঠানোর কিছু নিয়ম রয়েছে। সেসব মেনেই কোম্পানিগুলোকে প্রস্তাব পাঠাতে হবে। সব বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাব আসার পর বিশ্লেষণ করে নিয়ম অনুযায়ী গণশুনানির মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি।
দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। এখন দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে ২৩৩ কোটি ঘনফুট। বঙ্গোপসাগরে থাকা দুটি ভাসমান এলএনজি প্রক্রিয়াকরণ টার্মিনালের মাধ্যমে পাওয়া যায় ৬০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে বিদ্যুতে ব্যবহৃত হয় ৬৮.৩৭ শতাংশ, সারে ৯.৩৯ শতাংশ, ক্যাপটিভে ৫.৯২ শতাংশ, শিল্পে ৭.০৬ শতাংশ, হোটেল-রেস্টুরেন্টে ০.২৩ শতাংশ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ০.২৮ শতাংশ, সিএনজিতে ৩.০৭ শতাংশ. বাসাবাড়িতে ৫.০১ শতাংশ এবং চা বাগানে ০.৬৭ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জুলাই গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল বিইআরসি। বাসাবাড়িতে দুই চুলার খরচ ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা আর এক চুলার খরচ ৭৫০ টাকা থেকে ৯২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে, যা শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। মহামারিকালীন অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো ব্যাহত হবে।
গতকাল বুধবার এফবিসিসিআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পাওয়ার, এনার্জি, ইউটিলিটিস বিষয়ক এফবিসিসিআইয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রথম সভায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বৈঠকে এফবিসিসিআইয়ে সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জানান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে চীন ও ভারত আরো ২০ বছর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখবে। বাংলাদেশেও শিল্পের বিকাশের স্বার্থে দেশে মজুদ থাকা কয়লার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত সরকারের। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু।
তিনি বলেন, বাপেক্স একা না পারলে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে অনুসন্ধান কূপ খননে গতি আনা উচিত।
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবুল কাশেম খান বলেন, দেশে জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ নয়। দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও শিল্পায়ন অব্যাহত রাখতে দেশীয় সম্পদকে কাজে লাগানো জরুরি। কয়লা উত্তোলন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পক্ষে মত দেন তিনি।
কেন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব : নতুন যে দাম নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বর্তমান মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে দেয়া প্রস্তাবে কোম্পানিগুলো যুক্তি দিয়েছে যে, এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশি-বিদেশি গ্যাস কেনা, সরবরাহ, পরিচালন ব্যয় ইত্যাদি মিলিয়ে তাদের খরচ বেড়ে গেছে। আগামী ১ ফেব্রæয়ারি থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রয়োজন বলে তারা বলেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকার যে গ্যাস আমদানি করছে, সেখানে গ্যাসের দাম প্রচÐভাবে বেড়ে গেছে। সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেজন্য ফাইন্যান্স (অর্থ মন্ত্রণালয়) থেকে বলা হয়েছে, দাম সমন্বয় করতে হবে।
তিনি জানান, বিইআরসিতে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তারপর তারা শুনানি করে সিদ্ধান্ত নেবে যে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে, নাকি হবে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলছেন, বাংলাদেশের নিজস্ব যে গ্যাস রয়েছে, তার বড় একটি অংশ সরকার বিদ্যুৎ ও সার শিল্পে ব্যবহার করে। ফলে আবাসিক ও বেসরকারি খাতে যে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, সেটা মেটাতে হচ্ছে বেশি দামে আমদানি করা গ্যাস দিয়ে।
আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম ওঠানামা করার কারণে সরকারকেও সেই আমদানি করা গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে আবাসিক, যানবাহন ও শিল্পখাতের গ্যাসের দাম বাড়াতে চাইছে সরকার।
গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত কিনা, তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহ বলেন, এখন গ্যাসের দাম বাড়ানো একেবারেই যৌক্তিক না। দেশের ভেতরে যে গ্যাস রয়েছে, সেটা সরকার তোলে না। বরং বিদেশ থেকে আমদানির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। একটা চক্রকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে, বিশেষ সুবিধা দিতেই এটা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তার মানে আগে থেকেই গ্যাসের দাম বেশি করে আদায় করছে সরকার। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস আহরণ করার পরামর্শ দেন।
তবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমাদের এখানে অনুসন্ধান তো করছিই। নিজেদের থাকলে কেন আমরা বাইরে থেকে আমদানি করবো? কিন্তু আমাদের দেশে তো এতো গ্যাস নেই, যে সারাজীবন পাওয়া যাবে। চাহিদা বেড়ে গেছে, প্রচুর শিল্প হয়েছে, রপ্তানি বেড়েছে- এতো চাহিদা, গ্যাস দেবো কোথা থেকে? বাধ্য হয়েই আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে।