দুই গ্রুপের হাতে জিম্মি পতেঙ্গা সৈকতের সৌন্দর্য

106

মনিরুল ইসলাম মুন্না

প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত আউটার রিং রোড নির্মাণ করা হয়েছে। এই রাস্তা নির্মাণে পতেঙ্গা এলাকায় রাস্তা ও বাঁধ নির্মিত হয়েছে। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলেও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে দখলবাণিজ্য নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশে করা বাগান এখন হকারদের দোকানে পরিণত হয়েছে।
তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী এবং পতেঙ্গা সৈকত সৌন্দর্যবর্ধন ও আউটার রিং রোডের প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বিন শামস পূর্বদেশকে বলেন, ‘গত ৬ মাস আগেও একবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে সবকিছু তুলে দিয়েছি। এখন শুনছি, দখলদাররা সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট করে দিচ্ছে। শীঘ্রই আবার অভিযান দিয়ে সব উচ্ছেদ করব।’
পুনরায় দখল রোধ করতে উদ্যোগ নেয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সমুদ্র সৈকত এলাকার জন্য অপারেটর নিয়োগ দিবো। যাতে সৈকত এলাকায় কোন অবৈধ স্থাপনা গড়ে না উঠে। পরবর্তীতে কোন স্থাপনা করলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে।’
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা সমুদ্র সৈকত। দেশের দুর-দুরান্ত থেকে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে পর্যটকরা সৈকতপাড়ে আসলেও সৌন্দর্যের বিপরীতে রয়েছে নোংরা পরিবেশ, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা। এছাড়াও স্থানীয় দোকানি ও ব্যবসায়ীদের গলাকাটা বাণিজ্যে অসহায় পর্যটকরা।
সৈকতে বেড়াতে আসা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘স্পিড বোট রাইড, ঘোড়া রাইডসহ যত রাইড আছে সবকিছুরই অনেক দাম। শুধু রাইড নয়, এখানে খেলনা বা খাদ্যপণ্যের দামও বেশি যা অন্য কোথাও নেই।’
দুইটি গ্রুপের হাতে পুরো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত জিম্মি হয়ে আছে। এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। অর্থাৎ, সৈকত এলাকা থেকে চাঁদা তোলে দুটি গ্রুপ। এর একটি হলো ‘পতেঙ্গা সৈকত দোকান মালিক সমিতি’ এবং অপরটি ‘পতেঙ্গা সৈকত হকার্স সমিতি’। এ দুই গ্রুপের প্রত্যেকে স্থানীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত রয়েছেন বলে জানা যায়।
শুধু নেতারাই দোকান দিয়েছেন, তা নয়। পুলিশের পরিচালিত দুটি দোকানও রয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ যেখানে সমুদ্র সৈকত রক্ষার কাজ করবেন? সেখানে নিজেরা দোকান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তাহলে অন্য দোকানিদের উচ্ছেদ করবেন কীভাবে? যেটা মোটেও সমীচিন নয়।
গত বুধবার দুপুর তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকা ঘুরে অনেক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। স্থানীয় পুলিশকেও এসব ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। দোকানিদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠে, টাকার একটা ভাগ নাকি পুলিশও পায়।
তবে সব অভিযোগ মিথ্যা বলে জানান পতেঙ্গা থানাধীন সি-বিচ ফাঁড়ির ইনচার্জ হারুনুর রশিদ। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা ডিউটির পাশাপাশি যতটুকু পারি করে যাচ্ছি। চাঁদাবাজির বিষয়ে আমি অবগত নই আর এ বিষয়ে কিছু জানি না।’
একইভাবে পতেঙ্গা সাব জোন ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক ইস্রাফিল মজুমদার বলেন, ‘এখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ আমি করতে পারি না। এছাড়াও আমি যোগদান করার পর এখানকার প্রতিটি দোকানে লিফলেট দিয়েছি। কেউ চাঁদা চাইতে আসলেই যেন আমাকে জানায়। কিন্তু এখনও কেউ চাঁদাবাজির বিষয়ে জানায়নি। পাশাপাশি এসবের সাথে আমাদের সদস্যদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। আর যে দোকানের কথা বলছেন, তা আমাদের কল্যাণ ফান্ডে চলে যায়।’
সরেজমিন দেখা গেছে, পুরো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার দৈর্ঘ্য দুই কিলোমিটার। দূর-দূরান্তের পর্যটকরা আসেন একটুখানি সমুদ্রের দেখা পেতে। কিন্তু সমুদ্রের আর দেখা হয় না। পতেঙ্গা সি-বিচ অংশ থেকে বে টার্মিনাল পর্যন্ত সমুদ্রে পার্কিং করে রাখা হয়েছে বাল্ক জাহাজ এবং লাইটারেজ জাহাজ। আর সমুদ্রের পাড়ে সৈকত দখল করে তিন শতাধিক দোকান ও রাইড নিয়ে বাণিজ্য করছে সমিতির নাম দেয়া দুইটি সিন্ডিকেট। আবার গঙ্গা স্নান ঘাট থেকে খেজুর তলা পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক দোকান নিয়ে বাণিজ্য করছে আরও একটি সিন্ডিকেট।
দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ দুই সমিতি দোকান, গাড়ি ও মোটর সাইকেল পার্কিং, বিচ বাইক চালক, ঘোড়ার রাইডার, ক্যামেরাম্যান, স্থানীয় দোকানি থেকে চাঁদা আদায় এবং স্পিডবোট থেকে চাঁদা আদায় করে। মাসে এখান থেকে চাঁদা ওঠে ৩০ লাখেরও বেশি।
আরও জানা যায়, পতেঙ্গা সৈকতে গড়ে ওঠা প্রায় তিন শতাধিক স্থাপনার প্রতিটি থেকে প্রাথমিকভাবে এককালীন চাঁদা নেয় স্থানীয় এ দুই গ্রুপ। প্রতিটি দোকান বা স্থাপনা থেকে এ চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় দোকানভেদে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ হিসেবে এককালীন চাঁদা তোলার পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া প্রতিটি স্থাপনা থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে মাসে চাঁদা ওঠে ৩০ লাখ টাকার মত। চাঁদার এই টাকা দুই গ্রুপের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
পরিচয় গোপন রেখে কয়েকজন দোকানির সাথে কথা বলেন প্রতিবেদক। তারা জানান, প্রত্যেক দোকানদার অসহায়। কারণ তাদের নিজস্ব একটা পরিবার আছে। ধরুন, সৈকত এলাকায় দৈনিক এক হাজার টাকা বিক্রি হলে ২০০ টাকা চাঁদা দিয়ে দিই। বাকি ৮০০ টাকা তো বাড়িতে নিতে পারি। তাই সবাই চুপচাপ। কে কার বিরুদ্ধে বলবে? সবাই তো একই ঘরানার। তবে ইদানিং সৈকত এলাকায় বেড়ে গেছে দোকান ও চাঁদাবাজি। টাকার বিনিময়ে দোকান করতে পারেন দোকানিরা। একদিন টাকা না দিলে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে দুই গ্রুপ বা সিন্ডিকেট। একটা দোকান মালিক সমিতি অপরটা হকার সমিতি। আগে কাউকে চাঁদা দিতে না হলেও এখন দোকান করতে গেলে এ দুই গ্রুপকে চাঁদা দিতে হয়।
সমিতির নামে টাকা তোলা হলে কোন রশিদ দেয়া হয় কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা কোন টাকার রসিদ বা বই পাই না। এখানে দুটি সমিতির নাম ব্যবহার করা হলেও মূলত পুলিশসহ এ দুই গ্রুপের সদস্যদের পকেটে যায় এসব টাকা।
স্থানীয় দোকানিদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কথা হয় সমিতির নেতৃত্বে থাকা নুর মোহাম্মদের সাথে। তিনি টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা ২০ টাকা করে চাঁদা নিই, তাও সমিতির নামে। কিন্তু তার বাইরে কোন টাকা নেয়া হয় না।’
অপরদিকে দোকান মালিক সমিতির নেতৃত্বে থাকা ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘আমি কোন টাকা পয়সা তুলি না। ওগুলোর সাথে আমি জড়িত না।’
স্পিড বোটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে পর্যটকরা অভিযোগ তুলেছেন। এটাকে এক ধরনের গলাকাটা বাণিজ্য বলে উল্লেখ করেন তারা। বর্তমানে ১০০ টাকা টিকেটের মূল্য ৫০ টাকায় আনার দাবি জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন পর্যটক।
তবে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত স্পিড বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মুসা আলম বলেন, ‘বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বেশি। সে হিসেবে ১০০ টাকা এত বেশি নয়। তারপরও পর্যটকদের অভিযোগ মাথায় নিয়ে আমরা সদস্যদের নিয়ে বসে যতটুকু কমিয়ে আনা যায়, তা কমিয়ে আনবো।’
এ ব্যাপারে পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুর পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমিও চাই পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত সুন্দর থাকুক। ওখানে অবৈধ দোকানপাটের কারণে পুরো সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে আমি সিডিএ’কে চিঠি দিয়েছি। সিডিএ যদি উচ্ছেদ করে তবে আমার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে। এছাড়া আমি বা আমার থানা কোনো টাকা নেয় কি না আপনি গোপনে খবর নিয়ে দেখুন, এখানে হকারের কোন টাকা আসে না।’