দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি’র উন্নয়নে আ.জ.ম. নাছির উদ্দীন

125

সমবায় সমিতির ইতিহাস প্রায় মানবসভ্যতার ইতিহাসের ন্যায় প্রাচীন। বর্তমানের সমবায় সমিতির সাংগঠনিক রূপ প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের কিছু পূর্বেই। ১৭৬১ সালে সর্বপ্রথম ফেনউইক উইভারস সোসাইটি গঠন করা হয় স্থানীয় তাঁতীদের ঋণসুবিধা, শিক্ষা ও অভিবাসন সুবিধা দেওয়ার জন্য। ব্রিটিশ ভারতের জেনারেল লর্ড কার্জন সর্বপ্রথম ১৯০৪ সালে সমবায় সমিতি আইন জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমেই এই উপমহাদেশে সমবায় আন্দোলনের অভিযাত্রা শুরু হয়। “দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ” কিংবা “দশের লাঠি একের বোঝা” প্রভৃতি বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যগুলো সমবায় আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এর নিগূঢ় অর্থ হলো সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন। এই অভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লক্ষ্য অর্জনে সমবেতভাবে কাজ করার নামই হলো সমবায়।
বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের একটি সমৃদ্ধ এবং দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ-পরিক্রমা রয়েছে। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনকে অগ্রসর হতে হয়েছে। সমবায় শুধু মাত্র একটি উন্নয়ন দর্শনই নয়, এটি আর্থ-সামাজিক আন্দোলনও বটে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে এ আন্দোলন চলমান রয়েছে।


১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এই উপমহাদেশে এক বিরাট সামাজিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই প্রেক্ষাপটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শহরাঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে দেশান্তরিত মানুষের ভিড়ে আবাসিক সমস্যা প্রকট হয়ে উঠে। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের আর্থ-সামাজিক সংকটের কারণে এই আবাসিক সমস্যা সমাধান করা সহজ কাজ ছিল না। এমতাবস্থায় চট্টগ্রামের অভিজাত শ্রেণীর কতিপয় ব্যক্তিবর্গ বেসরকারী ভাবে আবাসিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সমবায় চেতনার মাধ্যমে ১৯৫১ সালে দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ প্রতিষ্ঠা করেন। যতটুকু জানা যায় দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ প্রথম সমবায়ী প্রতিষ্ঠান। তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত দৈনিক দি ইউনিটি পত্রিকার সম্পাদক এস.এম.মবিন এবং তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম.এ.মজিদ সিএসপি’র অক্লান্ত প্রচেষ্টায় দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ এর গোড়াপত্তন ঘটে। বিগত ৬৮ বছরে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে পরিচালিত ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর নেতৃত্বে দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ বর্তমানে দেশের অন্যতম সেরা সমবায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিগত ১৩ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ নির্বাচনের মাধ্যমে আলহাজ্ব আ.জ.ম. নাছির উদ্দীন সভাপতি ও মোহাম্মদ শাহজাহান সম্পাদক সহ সর্বমোট ১২ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি সোসাইটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ওচট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মাননীয় মেয়র আলহাজ্ব আ.জ.ম নাছির উদ্দীন সোসাইটির ব্যবস্থাপনা কমিটির বিগত তিন মেয়াদের এক মেয়াদে সম্পাদক ও দুই মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করায় তাঁর গতিশীল ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ এর বহুবিধ উন্নয়ন কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে, যার ফলে এই প্রতিষ্ঠানটি একটি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
এই সমবায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার পাঁচশত সদস্যদের আবাসিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেসোসাইটি ব্যবস্থাপনা কমিটি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমন্ব^য়ে বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। যার মধ্যে নাসিরাবাদ প্রকল্পে ১৬৫টি প্লট, খুলশী প্রকল্পে ১৭০টি প্লট এবং পাহাড়তলীর রোজভ্যালী আবাসিক প্রকল্পে ৫৮ টি প্লট সোসাইটিরসদস্যদের মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়। এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সোসাইটির নাসিরাবাদ, খুলশী ও রোজভ্যালী আবাসিক এলাকায় বরাদ্দকৃত প্লটে আনুমানিক ১৬০০ ফ্ল্যাট নির্মিত হয়েছে। এই তিনটি আবাসিক এলাকায় সমাজের গণ্যমান্য সরকারী, আধা-সরকারী ও বেসরকারী লোকজন বসবাস করেন। তাছাড়া খুলশী আবাসিক এলাকায় ৮ তলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ করে সদস্যের মধ্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হয়। তৎপ্রেক্ষিতে সোসাইটির বহু সদস্যের আবাসন সমস্যার সমাধান হয়েছে। রোজভ্যালী আবাসিক এলাকায় ৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে সোসাইটির সদস্যদের ভাড়া প্রদান করা হয়। খুলশী ও রোজভ্যালী আবাসিক এলাকায় রয়েছে অত্যাধুনিক মসজিদ ও পার্ক। ৩টি আবাসিক এলাকায় আলোকায়ন, সড়কের উন্নয়ন ও নালা সংস্কার করা হয়েছে। নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকায় ১০ তলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ করে ৩২ জন সদস্যের মধ্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দদেয়া হয়েছে। নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে ৫ তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক মসজিদ নির্মিত হয়েছে এবং নিজস্ব কবরস্থান এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সোসাইটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির জন্যকোনো উপযুক্ত অফিসগৃহ না থাকায় এর কর্মকান্ড পরিচালনায় সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। বর্তমানে সোসাইটির নাসিরাবাদস্থ নিজস্ব বহুতল ভবন এর ২য় তলায় প্রতিষ্ঠানটির জন্য সুবিন্যস্ত ও অত্যাধুনিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করায় এর কর্মকাÐ পরিচালনায় গতিশীলতা বৃদ্ধিপেয়েছে। সোসাইটির নাসিরাবাদ প্রকল্পের ২ নং সড়কের সোসাইটি পার্কটিতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নবীন, প্রবীণ ও শিশুদের বিনোদনের জন্য প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। পার্কটির কাজ সমাপ্ত হওয়ায় এটি চট্টগ্রামের একটি অন্যতম বিনোদন পার্ক হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্বার্থে তিনটি আবাসিক এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। সোসাইটির সভাপতি আলহাজ্ব আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের বলিষ্ঠনেতৃত্বে হাটহাজারীর বড় দিঘীর পাড় এলাকায় সোসাইটির চতুর্থ আবাসিক প্রকল্পচলমান। বর্তমানে শহর এলাকায় জমির অপ্রতুলতা ও আকাশ ছোঁয়া মূল্যের কারণে সোসাইটি ব্যবস্থাপনা কমিটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নাগরিক সুবিধা সংবলিত হাউজিং প্রকল্প গড়ে তোলার নিমিত্তে যানজটবিহীন ও দূষণমুক্ত পরিবেশে শহরতলীর বড় দিঘীরপাড়স্থ খিল্লাপাড়ায় সোসাইটির চতুর্থ প্রকল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ কানি জমি ক্রয় সম্পন্ন করেছে। আরো জমি ক্রয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই প্রকল্পে ৬৮ জন্য সদস্যকে ইতিমধ্যেই ৫ কাঠার (কম/বেশি) প্লট বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে, আরো ১০০ জন সদস্যকে কম/বেশি ৫ কাঠার প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলমান। হাই রাইজ বিল্ডিং এর জন্য ৩টি জোনে প্রায় ১৭৪ কাঠা জায়গা রাখা হয়েছে, যাতে অনেক সদস্যকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ প্রদান করা যাবে। প্রকল্পের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাট ও সীমানা দেয়াল নির্মাণ কাজ শীঘ্রই শুরু করা হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সোসাইটির অনেক সদস্যের আবাসন সমস্যা সমাধান হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ এর একটি নিজস্ব অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৪ সালে অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টিপ্রতিষ্ঠা করা হয়। কালের বিবর্তনের যথাযথ প্রশাসনিক ও একাডেমিক দক্ষতার উন্নয়নের লক্ষে বর্তমানে সোসাইটির সভাপতি ও সিটি মেয়র আলহাজ্ব আ.জ.ম নাছির উদ্দীন এর দক্ষ পরিচালনায় স্কুলটি দেশের শীর্ষস্থানীয় স্কুল হিসেবে ইতিমধ্যে সুখ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে স্কুলে প্লে হতে দশম শ্রেনি পর্যন্ত প্রায় ৩,৫০০ (তিন হাজার পাঁচশত) ছাত্র ছাত্রী ও ১০০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি নতুন ১১ তলা বিশিষ্ট আধুনিক স্কুল ভবনের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। নতুন একাডেমিক ভবনটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে এটি হবে চট্টগ্রামের স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম আধুনিক একটি স্কুল। ভবিষ্যতে এই স্কুলটিকে কলেজে উন্নীত করার পরিকল্পনা সোসাইটি ব্যবস্থাপনা কমিটির রয়েছে।
বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে বহু প্রতিষ্ঠান তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফলতা অর্জন করেছে। যার মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিপুলভাবে উপকৃত হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এর অধীনে সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক বিশেষ শ্রেণী, তাঁতী সহ অন্যান্য পেশা ভিত্তিক সমবায় শ্রেণী/ক্যাটাগরীতে জাতীয় সমবায় পুরস্কার- ২০১৭ এর জন্যশ্রেষ্ঠ সমবায়ী পুরস্কারে মনোনীত হয়েছে দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ, যা সোসাইটির বিগত ৬৮ বৎসরের ইতিহাসে এই প্রথম। এই পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে সোসাইটির সার্বিক কর্মকান্ড জাতীয়ভাবে স্বীকৃত হয়। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির মাননীয় সভাপতি আলহাজ্ব আ.জ.ম নাছির উদ্দীন এর সুযোগ্য নেতৃত্বে সফলভাবে সমবায় নীতি ও আইন অনুসরণ করে সোসাইটিকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। যার ফলে দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ জাতীয় সমবায়ের ইতিহাসে এক সোনালী অধ্যায়ের সূচনা করলো। তাঁর নেতৃত্বে এই পদক প্রাপ্তিতে গৌরবান্বিত হয়ে আমরা সোসাইটির সকল সদস্য গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত। সোসাইটির ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষথেকে সোসাইটির সভাপতি আলহাজ্ব আ.জ.ম নাছির উদ্দীন বিগত ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট থেকে এই পদক গ্রহণ করেন। এই অর্জন ও সম্মান সোসাইটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত সকল সম্মানিত সভাপতি, সম্পাদক সহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সকল সদস্যদের সম্মলিত প্রচেষ্টার ফসল। এই সম্মাননা ও পদক চট্টলবাসী এবং সোসাইটির সম্মানিত সদস্যদেরকে উৎসর্গ করা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেসরকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ আজ দেশের অন্যতম বৃহত্তম আবাসিক সমবায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এ সোসাইটি দেশের সমবায় আন্দোলনকে বেগবান ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে চলেছে। তাই এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সমবায়ী প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের মূল কারিগর সোসাইটির সভাপতি ও সিটি মেয়র আলহাজ্ব আ.জ.ম. নাছির উদ্দীন।
লেখক : সম্পাদক,
দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ