দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ…

261

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা Centre For Economic And Business Research) ms‡ÿ‡c (EBR) বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর একটি ব্যাপক জরিপ চালিয়েছে এবং কতগুলি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এই সংস্থার জরিপ মতে আগামি ১৫ বৎসরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে ২৪তম স্থানে পৌঁছবে। ২০১৮ সালে যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থান ছিল বিশ্বে ৪৩তম। সংস্থাটি দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেছে ২০১৭ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে ৭% হারে বাড়বে। বর্তমান বাজার মূল্যে বাংলাদেশের জি,ডি,পি দাঁড়াবে ১.০৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে আমাদের জি,ডি,পি হলো ২৮৬.৮২ বিলিয়ন ডলার অথচ ১৯৭১ ইংরেজিতে আমাদের জি,ডি,পি ছিল মাত্র ৪.৩ বিলিয়ন ডলার। কাজেই ঊইজ এর হিসাব মতে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের জি,ডি,পি দাড়াঁবে ১.০৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১০০০ বিলিয়নের থেকেও বেশি। কিন্তু এই অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাধারণ মানুষের কতটুকু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে। যদি সাধারণ মানুষ তথাকথিত উন্নয়নে উপকৃত না হয় এবং দেশের গুটিকয়েক মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমতে থাকে এবং ঐ লোকগুলি তাদের ও এই বিপুল সম্পদ দেশে নিরাপদ নয় বলে বিদেশে বিভিন্নভাবে পাচার করতে থাকে, সে ক্ষেত্রে ইহাকে সত্যিকার অর্থে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যায় কিনা তা নিয়েও গভীর আলোচনা এবং গবেষণার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই দৃশ্যটি কিন্তু শুধু বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়, সারা বিশ্বের বেশিরভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে সঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যখন আয়ের হিসাবটা মাথাপিছু করা হয় (চবৎ পধঢ়রঃধ) তখন মনে হবে সব মানুষ এই সম্পদ বৃদ্ধিতে উপকৃত হচ্ছে, আসলে তা নয়।
সম্প্রতি সুইজারল্যন্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা “অক্সফাম’’ এর সম্মেলনে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বর্তমান বিশ্বে ধনী দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য দ্রæত গতিতে বেড়ে চলছে। ঐ প্রতিবেদনে অক্সফাম জানিয়েছে বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠির অর্ধেকের অর্থাৎ ৩৮০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের সমান সম্পদ রয়েছে বিশ্বের মাত্র ২৬ জন ধনীর হাতে। অক্সফামের দেওয়া রিপোর্টে দেখা যায় ২০১৮ সালে বিশ্বের ধনীরা আরো ধনী হয়েছে এবং দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয়েছে। এই বৈষম্য বাড়ার হারটা এত বেশি তা কল্পনায় আনা ও কষ্টকর এবং অনেকেটা অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়। যদি শীর্ষ ধনীদের আয়ে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদের উপর কর আরোপ করা যায়, তাহলে বাৎসরিক ৪১ হাজার ৮৯০ কোটি ডলার অর্থ আসবে, সে অর্থ স্বাস্থ্য সেবায় ব্যয় করলে ৩০ লক্ষ লোকের স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা যাবে । সম্প্রতি লন্ডনের ‘লার্ডিয়ান’ পত্রিকায় অক্সফামের সদ্যসমাপ্ত সম্মেলনে দেওয়া বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে,বিশ্বের ২০০ বিলিওনিয়ারের ২০১৮ সালে সম্পদের মূল্য বেড়েছে ৯০ হাজার কোটি ডলার। অথচ পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পত্তি কমেছে ১১ শতাংশ। এখন বিশ্বের অর্ধেক মানুষের যত সম্পত্তি তত পরিমাণ সম্পদ মাত্র বিশ্বের ২৬ জন মানুষের হাতে সঞ্চিত হয়েছে। অক্সফামের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের প্রত্যেক ২ দিনের মধ্যে একজন করে বিলিওনিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। মি. জেক্ বেজস্ হলেন বিশ্বের একজন বড় মাপের ধনী, এক বৎসরে যাঁর সম্পত্তি বেড়েছে ১১২ বিলিয়ন ডলার। ইথিওপিয়ার মোট জন সংখ্যা হলো ১০৫ বিলিয়ন। সে দেশের স্বাস্থ্য বাজেটের সমান। আজকে পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশে একই অবস্থা চলছে। আগে বিশ্বের সমাজকতান্ত্রিক দেশগুলিতে পুঁজিপতি হওয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে পুঁজিপতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলিকে হার মানিয়েছে। বর্তমানে চীন হলো বিশ্বের সবচাইতে বেশি ধনী লোকের স্থান। ১৯৭৮সালে চীনের জি,ডি,পি ছিল মাত্র ১৫ হাজার কোটি ডলার চল্লিশ বৎসরের মধ্যে চীনের জি,ডি,পি এখন ১২ লাখ কোটি ডলার। চীনের বর্তমানে একটাই লক্ষ্য যুক্তরাষ্টকে টপকানো।
বর্তমানে সবচাইতে বড় উদ্বেগের কারন হয়েছে, এই কোটিপতিদের হাতে রাষ্ট্রীয়নীতি নির্ধারণের ভারও চলে যাচ্ছে। কারন রাষ্ট্র যাঁরা পরিচালনা করেন, পুঁজিপতিদের দাফটের কাছে তারাও অনেকটাই অসহায় হয়ে পুঁজিপতিদের জালে আটকে পড়েছে এবং এঁদের ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণীত হচ্ছে। মনে করেন অ্যাপল ,মাইক্রোসফট ,আমাজান, গুগল এবং ফেসবুকের সম্মিলিত বাজার মূলধন ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার , বা গত বছর জার্মানির দেশজ উৎপাদনের চাইতে বেশি। অক্সফাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে তা হল ১৯৮০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশেষ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রাপ্ত ডলারের মধ্যে মাত্র ১২ সেন্ট অর্জন করেছে পৃথিবীর অর্ধেক দরিদ্র মানুষ। বিপরীতে ধনী ১শতাংশ প্রতি ডলারে ২৭ সেন্ট পেয়েছে।
সম্পদের বৈষম্য নিয়ে গবেষণা করে বিশ্বের এমন সব প্রতিষ্ঠানগুলির জরিপে বাংলাদেশের সম্পদের বৈষম্য ফুটে উটেছে। সেসব গবেষণায় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ও অতিধনী বেড়ে যাচ্ছে এবং ধনী বৃদ্ধির তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে রয়েছে। অথচ ধনীদের কারণে বাংলাদেশে প্রচুর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে তাও বলা যাবে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে তা চীন, রাশিয়া ,ভারত এবং জাপান সহ অন্যান্য দেশের দেওয়া ঋণের টাকায় মেগা প্রজেক্টগুলো সরকারী উদ্যোগে হচ্ছে কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধনীদের অংশ গ্রহণ খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়না, বরং বিভিন্নভাবে দেশ থেকে বিদেশের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের ব্যাপারে তারা বিস্ময়কর দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ‘ইন্টিগ্রিটি’ নামে প্রতিষ্ঠানটি এক প্রতিবেদনে বলেছেন ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।
বাংলাদেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা আমদানির ক্ষেত্রে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ (আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য কম দেখানো) এবং রপ্তানি ক্ষেত্রে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ (রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো) করে বিদেশে টাকা পাচার করছে। এই প্রক্রিয়ায় বিদেশে অহরহ টাকা পাচার চলছে।
বাংলাদেশের ধনীদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য বি,বি এসের জরীপেও প্রকাশিত হয়েছে। বি,বি এসের জরীপ প্রতিবেদনে দেখা যায়। ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ছয় বৎসরে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশে পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে অতি গরীব ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। সম্পদ বাড়লেও অন্ততঃ সেগুলি যদি দেশে থাকে তাও মানা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় দেশের ধনীদের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমরা যারা অর্থনীতির ছাত্র সদাসর্বদা এ ব্যাপারে বলছি এবং লিখছি কিন্তু সরকারের এই ব্যাপারে কোন দৃঢ় পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা।
যাই হউক, শুধু বাংলাদেশের নয়.পৃথিবীর সম্পদ অতিদ্রুত গুটিকতক মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে। যে হারে বিশ্বের সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে তা বিষ্ময়কর। এই বৎসের দেওয়া অক্রফামের প্রতিবেদন বলা হয়েছে বিশ্বের মাত্র ২৬ ব্যক্তির কাছে ৩৮০ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদ রয়েছে। কিন্ত ২০১৭ সালে একইসংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদ ৪৩ জন ধনকুবরের হাতে ছিল। তারপরের বৎসর অথাৎ ২০১৬ সালে এই সম্পদ ছিল ৬১ জনের হাতে। কিন্ত এর বিপরীতে দরিদ্রদের সম্পদ আর ও কমেছে। এইভাবে বলতে থাকলে আগামী ৩ বৎসরের মধ্যে বিশ্বের ৩৮০ কোটি দরিদ্র জনগোষ্টির সম্পদ মাত্র ৬ জন ধনীর হাতে চলে আসবে। বিশ্বের চারজন শীর্ষ ধনীর নাম হলো জেপবেজোস, বিল গেটস, ওয়ারেট বাফেট ও মার্ক জুকারবার্গ এই চার জন ধনীর মোট সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ৩৫ হাজার ১০ কোটি ডলার। এই তথ্যগুলি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পাক্ষিক ম্যাগাজিন ফোবার্স এর দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এই ম্যাগাজিন বহু পুরানো। অনেক বৎস ধরে সম্পূর্ণ বিশ্বস্থতার সহিত এই জাতীয় পরিসংখ্যান দিয়ে আসছে।
বিশ্বের ৩৮০ কোটি গরীরের সম্পদ গত বৎসর ১১ শতাংশ কমেছে। এর বিপরীতে ২২জন ধনীর সম্পদ বেড়েছে ৯০ হাজার কোটি ডলার। অবশ্য বাংলাদেশি কোন ধনীর নাম উল্লেখিত লিস্টে নাই। প্রশ্ন হলো বিশ্বের সিংহ ভাগ সম্পদ যদি গুটি-কয়েক লোকের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তাহলে বিশ্ব অর্থনীতির বা বিশ্বের কোটি কোটি দরিদ্রপীড়িত মানুষের কি হবে ?
এই ব্যাপারে বিশ্বের কোথাও কোন উদ্যোগ বা উদ্বেগ আছে বলে জানা যায়না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু আছে বলে প্রচার করা হয়। এর চাইতে ডাহা মিথ্যা বা সত্যির অপলাপ আর কিছু হতে পারে না। আজ পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সমস্ত নিয়ম চলে আসছে – এসত্য স্বীকার না করার মধ্যে বিবেকের প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নেই। বিশ্বের যত ধর্ম আছে ইসলাম, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ইত্যাদি প্রত্যেক ধর্মই এইভাবে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যারা ধর্মের মূল্যবোধগুলি প্রচারের অধিকার রাখেন তারাও নীরব। কারণ তাদেরকেও পুঁজির মায়ায় পেয়েছে।
আজকাল সাম্যবাদীরাও এসব ব্যাপারে তেমন কিছু বলেন না। কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতির নিয়ম হলো নিপীড়িত মানুষ অবশ্যই জাগবে তখন,
‘‘উৎপীড়িতের ত্রুন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবেনা।’’

লেখক : কলামিস্ট