দাম বেড়েছে সব নিত্যপণ্যের

42

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাভাবিকভাবে চাহিদার তুলনায় পণ্যের স্বল্পতা সব সময় বিদ্যমান। এরই মধ্যে লোডশেডিং এর প্রভাবে পণ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ কমে গেছে। এতে বৃদ্ধি পায় সবধরণের পণ্যের দাম। এর সাথে সর্বশেষ যুক্ত হয় ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানির দামবৃদ্ধির প্রভাব।
একদিকে যেমন মানুষের আয় বাড়েনি। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সীমিত আয়ের মানুষের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অসহায় হয়ে পড়েছে মধ্য, নিম্নবিত্তসহ সাধারণ জনগণ। মূল্যবৃদ্ধির এমন অবস্থার ফলে বাজারে মজুদ, সরবরাহ তথা মনিটরিংয়ের মত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতিনিয়ত সব ধরণের পণ্যের দাম বাড়ছে। গৃহস্থালির টুকিটাকি পণ্য থেকে শুরু করে দেশি বিদেশি সব ধরণের মালামাল, এমনকি চিকিৎসা সামগ্রী সর্বক্ষেত্রে দামবৃদ্ধি থেকে বাদ পড়ছে না। এক কথায় জ্বালানি তেলের প্রভাব সর্বক্ষেত্রেই পড়ছে।
জানা গেছে, গত কয়েকদিনে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। নগরীর বিভিন্ন বাজারে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তাৎক্ষণিকভাবে নয়টি বিভিন্ন পণ্যের দাম আরও এক দফা বেড়ে যায়। এই নয়টি পণ্যের মধ্যে রয়েছে, চাল, চিনি, আটা, ময়দা, মুরগি, ডিম, কাঁচামরিচ, টমেটো ও রসুন। পাশাপাশি বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মাছ ও সবজি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন করে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। একই কারণে চলতি সপ্তাহে আরো কিছু পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
চকবাজার মুদির দোকানীদের তথ্যমতে, ডিজেলের দামবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে তিন-চার দিনের মধ্যে প্রতি ৫০ কেজি চালের বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দাম বেড়েছে। ৫০ কেজির জিরাশাইল বস্তা প্রতি ৩ হাজার ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫৫০ টাকায়। দেশি বেতি আতপ ২ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ৩৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিন দিনের ব্যবধানে বস্তা প্রতি দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। এছাড়া খুচরায় প্রতি কেজি জিরাশাইল ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৭ টাকায়। দেশি বেতি ৫৭ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকায়, মিনিকেট ৬০ টাকা থেকে ৬৪ টাকায় ও মোটা জাতের নুরজাহার ব্র্যান্ডের ৫০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৩ টাকায়। এছাড়া গত কয়েক মাস ধরে চিনি ৭৪ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৩ থেকে ৮৪ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে চিনিতে দাম বেড়েছে ৯ থেকে ১০ টাকা। প্রতিকেজি আটা কোম্পানি ভেদে ৫৩ টাকা থেকে বেড়ে ৫৮ টাকায়, ময়দা ৬৮ টাকা থেকে বেড়ে ৭৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আটা কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকা এবং ময়দা কেজিতে বেড়েছে ৬ টাকা।সরেজমিনে কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১৫ টাকা বেড়ে কাকরোল ৫৫ টাকা, ঢেড়শ ১০ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা, টমেটো ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা, পটল ১০ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ১০ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা, পেঁপে ১০ টাকা বেড়ে ৪০ টাকা, বেগুন ১৫ টাকা বেড়ে ৬০ টাকা, মরিচ ৪০ টাকা বেড়ে ২৮০ টাকা, কচুর লতি ১০ টাকা বেড়ে ৬০ টাকা, শসা, চিচিঙ্গা, লাউ, ঝিঙ্গা ১০ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা, বরবটি ও তিতকরলা ২০ টাকা বেড়ে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচ পাঁচদিনের ব্যবধানে বেড়েছে ৬০ টাকা ও টমেটোতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত।
সবজি বিক্রেতা মো. এরশাদ বলেন, চাহিদার তুলনায় পণ্যের সংকট দেখা দিলে দাম আরও বাড়তে পারে।
কাজির দেউরীর মুরগি বিক্রেতা আব্দুল মালেক বলেন, ব্রয়লার মুরগি কেজি সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ টাকা দাম বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগি ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। অন্যজাতের মুরগির দাম স্বাভাবিক। ডিম বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, ডিম ডজনপ্রতি ১২৫ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫০ টাকায়। ডিমের প্রতিডজনে দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত।
রেয়াজউদ্দিন বাজারের সোবহান স্টোরের স্বত্বাধিকারি মো. শোয়াইব বলেন, হয়তো দু-এক দিনের মধ্যে একটি ডিমের দাম ১৫ টাকা হবে। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে কোথাও কোথাও ২০ টাকা বেড়ে গেছে। সরকারের বেঁধে দেয়া ১৮৫ টাকা দামে আর সয়াবিন তেল পাওয়া যায় না। চাল, ডাল, চিনি, দুধ সব পণ্যের দামই গত দুই-তিন দিনে কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা করে বেড়েছে।
বাজারের এমন অবস্থায় অসহায় সাধারণ জনগণ। অনেকে বলছেন, নুন আনতে পানতা ফুরিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয় আর বেশি দিন নেই। দেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহ হচ্ছে।
একটি বেসরকারি অফিসে কর্মরত মো. জাহাঙ্গীর আলম বাজারে গিয়ে অনেকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তিনি তার সব পণ্যই আগের চেয়ে পরিমাণে কম কিনতে বাধ্য হন। ১০ হাজার টাকা বেতনের এই চাকরিজীবী বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কীভাবে টিকে থাকবেন তা ভাবতে পারছেন না। গত তিন বছরে তার বেতন বাড়েনি। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগের দর আর আজকের দরের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ টাকা তফাৎ রয়েছে। শুধু পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের দাম বোতলের গায়ে লেখা আছে ৯১০ টাকা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৯৯৭ টাকায়। ৮৭ টাকা বেড়ে গেছে। মুরগির ক্ষেত্রেও একই। এমন অবস্থায় চলব কেমনে?
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই পরিস্থিতিতে আমাকে ব্যয় কমাতে হচ্ছে। যেমন আগে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার আমাদের পরিবারে আমরা গরুর মাংস খেতাম। এখন চার সপ্তাহে একবার খাই। মুরগির মাংস সপ্তাহে দুই দিন খেতাম, এখন দুই সপ্তাহে একদিন খাই। মাছ খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি। বাচ্চাদের খাবারসহ সব কিছুই আগের চেয়ে কম কিনছি।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর এই কয়েকদিনে প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ বেড়েছে। আর এটা সাধারণ মানুষকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলেছে। মানুষ কম খেয়ে অথবা এক বেলা না খেয়ে টিকে আছে। আবার এখন যে ঋণ করে সামাল দেবে তাও পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, জ্বালানি তেলের দামের কারণে সব কিছুর দামই বাড়ছে। কিন্তু যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়ছে। সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই সুযোগ নিচ্ছে, সবজি দোকানদার থেকে শুরু করে সবাই। চাল আমদানির সুযোগ দেয়ার পরও চালের বাজারে সংকট তৈরি করা হয়েছে চাল মজুদ করে। ভোজ্য তেলেও তাই করা হচ্ছে। বাজার মনিটরিং বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না।