দাম বাড়ানোর ‘প্রস্তাবেই’ আরও অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার

35

ফারুক আবদুল্লাহ

ভোজ্যতেলের বাজারে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এক বছরের ব্যবধানে বাজারে সয়াবিন তেলের দাম পাঁচবার বেড়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে লিটারে বোতলজাত সয়াবিনের দাম আট টাকা বাড়িয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ২০ দিন যেতে না যেতেই নতুন করে আবারও সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাবে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকটে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বাজার। সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল।
গতকাল মঙ্গলবার নগরীর খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ভোজ্যতেল নেই। বোতলজাত তেলও সরবরাহ কম। এ কারণে খুচরা বিক্রেতারা খোলা সয়াবিন, পাম তেল ও বোতলজাত তেল নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন। পাইকাররা জানান, মিলাররা ইচ্ছা করে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট সৃষ্টি করেছেন।
নগরীর বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহীম জানান, পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল পাওয়া যাচ্ছে না, এ কারণে দাম বাড়তি। মঙ্গলবার ৫ লিটার রূপচাঁদা তেল ৮১০ টাকা, পুষ্টি ৮০০ টাকা, বসুন্ধরা ৮০০ টাকা এবং সেনা ৮১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একই অবস্থা চকবাজারেও।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতি জানায়, কয়েকটি বড় আমদানিকারকের তেল সরবরাহ বন্ধ থাকায় বাজারে খোলা তেলের কিছুটা সংকট হয়েছে। এ কারণে দাম একটু বেশি। আমদানিকারকরা তেলের মূল্য বাবদ যে স্লিপ দেন, তাতে কখনই লিটারপ্রতি দর লেখা থাকে না। দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে বারবার অনুরোধ করলেও মিলাররা তা মানছেন না।
টিকে গ্রুপের ম্যানেজার মো. রফিক বলেন, সরকারি নির্ধারিত দামে তেল বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ ব্যবস্থাও স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত তেল বাজারে সরবরাহ করছে না। তেল নিতে গিয়ে ফেরত আসতে হচ্ছে।
এই বিষয়ে মো. রফিক বলেন, আমাদের যতটুকু সক্ষমতা আছে ততটুকু দেওয়া হচ্ছে। সক্ষমতার বেশিতো আর দেওয়া সম্ভব না। তেলের বাজারের পরিস্থিতি বলতে গেলে আগের মতই আছে।
ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্তি দায়িত্ব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে শাহ আজিজ মৃধা নামের এক ব্যবসায়ী মন্তব্য করেন, সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপ খোলা সয়াবিন ডেলিভারি দিচ্ছে না গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। তাতে বাজারে অনেক ক্রাইসিস চলছে। আমরা বিক্রি করার জন্য সয়াবিন পাচ্ছি না। আমাদের ট্রাক দিনের পর দিন কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে বসে আছে, তাতে অনেক টাকা ডেমারেজ দিতে হচ্ছে। এই কারণেই সয়াবিন তেলের মূল্য অটোমেটিক বেড়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ভোজ্যতেলের বাজারে রীতিমতো চলছে চরম নৈরাজ্য। বিশ্ববাজারে দামবৃদ্ধির কথা বলে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে বরাবরের মতো রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম যেভাবে বেড়েছে দেশে তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম ছিল প্রতি টন ৮২৫ ডলার। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩২২.২৫ ডলারে। অর্থাৎ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ।
টিসিবির তথ্যমতে, এই সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশে পাম তেলের দাম বেড়েছে ৮৭ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে খোলা পাম তেলের লিটার বিক্রি হয়েছে ৭৩ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৩৬ টাকায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে পাম তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি বাড়ানো হয়েছে। একই সময়ে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টন ৫৬৪ ডলার থেকে বেড়ে ১৪৪০ ডলার হয়েছে। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। এছাড়া বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৯৭ শতাংশ। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে এ তেল বিক্রি হয়েছিল লিটার ৮৫ টাকায়। যা এখন দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬৮ টাকা। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি বাড়ানো হয়েছে। এদিকে গত সোমবার রাতে রাজধানীর একটি হোটেল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত এক কর্মশালায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, রমজানের আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে না। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে এসেছিলেন। তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। আমরা তাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছি। রমজানের আগে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হবে না।