দাম বাড়লেও সরবরাহ বাড়েনি বিদ্যুতের

20

মনিরুল ইসলাম মুন্না

চলছে মাঘ মাস। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে শীত পড়ছে। চট্টগ্রামেও শীত পড়ছে বেশ। তীব্র এ শীতের মাঝেও দেখা দিয়েছে লোডশেডিং। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবমতে চট্টগ্রামে দিনে ৫০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে। তাও নির্ভর করে বিদ্যুতের উৎপাদন, সরবরাহ ও চাহিদার উপরে।
অনেক এলাকায় দিনে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হলো। এরপর আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। লোডশেডিং রেখে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যুক্তিযুত নয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন গ্রাহকেরা।
গ্রাহকদের মতে, শীতেই যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে গরমের মৌসুমে কী হবে? কিছুদিন পর রমজান, পাশাপাশি সেচের কাজ কীভাবে চলবে। যদিও কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করে জানিয়েছে, শিগগিরই কেটে যাবে সংকট।
শীত মৌসুমে তুলনামূলক কম বিদ্যুৎ চাহিদার সময়ও চলছে লোডশেডিং। নগরীর বাইরে অনেক এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, ‘উৎপাদন ব্যয় কমাতে জ্বালানি তেলচালিত বেশির ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ রেখেছে সরকার। চট্টগ্রামে বর্তমানে ১০৫০ থেকে ১১৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত চাহিদা থাকে। তা আবার গ্রাহকের ব্যবহারের উপর কম-বেশি হয়। দেশে বিদ্যুৎ খাতে যেমন ঘাটতি নেই, তেমনি চট্টগ্রামেও বিদ্যুৎ সরবরাহে আমাদের কোন কৃপণতা নেই। কিন্তু জাতীয়ভাবে জ্বালানির সংকট থাকায় উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। এতে এক ফিডার বন্ধ রেখে অন্য ফিডারে সরবরাহ করে বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগগুলো। তবে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় চট্টগ্রাম অনেক ভাল অবস্থানে আছে। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের সমাধান হলে সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে’।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) উপাচার্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি সংকট রয়েছে। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমে গেছে। বেশি দামে জ্বালানি কিনতে গেলে সরকারের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি জনগণের উপরই চাপ পড়বে। জনগণের উপর চাপ পড়–ক, তা কখনো সরকার চায় না। সবকিছু সহনশীল পর্যায়ে থাকুক, তা সরকার চায়। বিদ্যুতের উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও সঞ্চালনসহ সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে। এতে সরকারের বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। এক কথায় বলতে গেলে সরকার নিরূপায় হয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকারের ক্ষতির পরিমাণটা বেশি হোক, তা চাচ্ছে না। তাই সহনশীল পর্যায়ে রাখতে কিছুটা লোডশেডিং করছে।’
একসময় ভুলতে বসা লোডশেডিং গত জুলাই মাসে ঘোষণা দিয়ে আবার ফিরে আসে। সেসময় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, অক্টোবরে শীত মৌসুমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। হয়েছেও তাই। তবে ভরা শীতে আবারো ফিরেছে লোডশেডিং। যা গ্রাহকদের ভাবিয়ে তুলেছে গরমে কী হবে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, শীতে বিদ্যুৎ তেমন ব্যবহার করা হয় না। তাই বিদ্যুতের ঘাটতিটা বোঝা যাচ্ছে না।
শীত মৌসুমে গড়ে প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ৯ হাজারের কিছু বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন বিদ্যুতের উৎপাদন ও পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় দেশে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১০ হাজার ৩০৮ মেগাওয়াট। সর্বনি¤œ উৎপাদন ছিল ভোর ৫টায় ৭ হাজার ১০১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সারাদেশে ১৬৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। পাশাপাশি চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন ছিল ৯৭২ মেগাওয়াট। আবার একইদিন চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল পিক আওয়ারে (বিকেল ৫টা-১১টা) ৯২৮ মেগাওয়াট এবং সরবরাহ ছিল ৯২৮ মেগাওয়াট। সুতরাং পিক আওয়ারে লোডশেডিং ছিল না। তবে দুপুর ১২টা থেকে ২টার মধ্যে ৫০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং ছিল।
এদিকে সংকট স্বীকার করে দায়িত্বশীলরা বলছেন, দেশে কয়লার অভাবে একদিকে রামপাল আর অন্যদিকে পায়রা থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ মিলছে না। আবার ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারায় কয়লার আমদানিও হচ্ছে না পর্যাপ্ত। যে কারণে লোডশেডিং হচ্ছে সারা দেশেই। চট্টগ্রামেও বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। যেখানে গত মঙ্গলবার শিকলবাহা বারাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা, সেখানে জ্বালানি সংকটের কারণে মাত্র ৫১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছে।
এদিকে, এপ্রিলে আসছে গরমকাল। সঙ্গে যুক্ত হবে রমজান। উৎপাদন পরিস্থিতি এমন থাকলে সংকট আরও ঘনীভ‚ত হওয়ার শঙ্কা ক্যাবের। যদিও এই পরিস্থিতি কেটে যাবে- এমন আশা করছেন তারা।
গ্রাহক রহিমা আক্তার বলেন, ‘প্রতিমাসে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি বা না করি কিন্তু মিটারের নানা চার্জ চলে আসছে। আবার বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার সবদিক দিয়ে চাপলে আমরা কোথায় যাবো? দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পরিবহন ভাড়া ইত্যাদি মিলিয়ে মানুষ এখন দিশেহারা। এভাবে চলতে গেলে মানুষ বেঁচে থাকার মন মানসিকতা হারিয়ে ফেলবে।’
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন পূর্বদেশকে বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সেটি দিতে পারছে না। প্রাথমিকভাবে জ্বালানির অভাব, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া এমন পরিস্থিতিতে লোডশেডিং করা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা। গ্যাস খাতে আমরা দেখেছিলাম যে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করে ঘাটতি বা ভর্তুকি মোকাবিলা করা যায়। তো বিদ্যুৎ খাতের ঘাটতি-ভর্তুকি সমন্বয় করার সুযোগ থাকা সত্তে¡ও কোনো সাশ্রয় হয়নি; বরং বেড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে গ্যাস নেই, অন্যদিকে কয়লাও নেই। আবার এসব কেনার জন্যও নেই পর্যাপ্ত ডলার। সংকট কাটাতে গ্যাস বা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোই একমাত্র সমাধান নয়।’
প্রসঙ্গত, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল। গড়ে ওই সময় ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। আর চট্টগ্রামে থাকে ১১০০ থেকে ১২০০ মেগাওয়াট। এখন শীতের সময় বিদ্যুতের চাহিদা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ থেকে ৭ হাজার মেগাওয়াটে। আর চট্টগ্রামে এক হাজার ৫০ থেকে ১১০০ মেগাওয়াটে। অথচ এটা সরবরাহ করা যাচ্ছে না।