দাদা ওরফে সিরাজুল আলম খান

5

ডা. হাসান শহীদুল আলম

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ কুমিল্লা শহর পাক হানাদারমুক্ত হয়। ভোরের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে ভারতীয় সৈন্যদের সাথে জীপে ট্রাকে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করছে। বিজয়ের আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশে গুলি ছুঁড়ছে।সহপাঠি যোদ্ধাদের বুকে জড়িয়ে আবেগে কান্না করছি।ওদের গায়ে বারুদের গন্ধ। আমি কুমিল্লা জিলা স্কুলে মেট্রিক পরীক্ষার্থী।বিকেলে ধর্মসাগরের পাড়ে বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের বাদাম খাওয়ার আসরে বসেছি। ওদের কথাবার্তার ফাঁকে ‘দাদা’ সম্বোধন শুনে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলে জানলাম এই দাদা মানে সিরাজুল আলম খান। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত একটি ক্ষুদ্র সত্ত্বা দীর্ঘসময় গোপনে কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছিল। এই ক্ষুদ্র সত্ত¡াটি ছিল নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াস যেমন কোষের প্রান বা মৌলের কেন্দ্র ঠিক তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল উক্ত নিউক্লিয়াস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মধ্যে সুস্পষ্ট দুটি ধারা বিদ্যমান ছিল। একটি ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিজস্ব রাজনীতির ধারা এবং অপর অংশের ঝোঁক ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নিজস্ব রাজনীতির ধারার তিনজন ছাত্রনেতা ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করে। ঐ তিনজন ছাত্রনেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ।তিন সদস্যের এই ক্ষুদ্র সত্ত্বা পরবর্তীতে নিউক্লিয়াস হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ঐ বৎসরের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন ঢাকা হলে যা
বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল নিউক্লিয়াসের মিটিংএ সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি উথ্বাপন করলে কাজী আরেফ আহমেদ এ বিষয়ে একমত হন (নিউক্লিয়াস, বিএলএফ, স্বাধীনতাঃ বাংগালীর জাতি রাষ্ট্র, কাজী আরেফ আহমেদ)। স্বাধীন বাংলাদেশের উপর নিউক্লিয়াসের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো খুবই গোপন বৈঠকের মাধ্যমে। কাজেই নিউক্লিয়াসের কার্যক্রম পরিকল্পনা মাফিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া ছিল কল্পনাতীত বা রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল। সিরাজুল আলম খান ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এর যাবতীয় কর্মকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। বংগবন্ধুর পরামর্শে পরবর্তীতে শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদকে নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।নিউক্লিয়াসের কার্যক্রম এতটাই গোপনীয় ছিল যে স্বয়ং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের সদস্যরা দলের সভা, আলোচনা বা কার্যক্রমে যোগদান করলেও বুঝতে পারতো না যে এটা নিউক্লিয়াসের কর্মশালার একটা কার্যক্রম। নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে ১৯৬৪ সালে কাজী আরেফ আহমেদের পৈত্রিক নিবাস পুরোনো ঢাকার ১৪/৩ অভয় দাস লেনের বাড়িতে একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন স্থাপন করা হয়। এই মেশিনে মুদ্রিত ‘জয় বাংলা’ ও ‘বিপ্লবী বাংলা’ নামে স্বাধীনতার ইশতেহার প্রচার করা হতো। নির্দেশ ছিল যে এই ইশতেহার পড়ার পর পুড়িয়ে বা ছিঁড়ে ফেলতে হবে। নিউক্লিয়াসের কাজ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে যাবতীয় নীতি কৌশল প্রণয়ন করা এবং স্বাধীকার আন্দোলনকে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া।
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ছিল এই তিন ছাত্রনেতার কাছে। দেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচী বিশেষত শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ৬২ সালে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন, শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ছয় দফা, ৬৯ এর গনঅভ্যুত্থান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফার আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলনকে গণরূপদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলা এবং একই সাথে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করা ছিল নিউক্লিয়াসের অন্যতম কাজ। ১১ দফা কর্মসূচি প্রনয়ন এবং এ আন্দোলন পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের রূপ দানে নিউক্লিয়াস নেতাদের ভ‚মিকাই প্রধান ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি,২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় সংগীত নির্বাচন, জয়বাংলা বাহিনী গঠন এবং তার কুচকাওয়াজ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক অভিবাদন জানানো, ৭ই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, সর্বোপরি বাংগালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ সহ সকল কর্মকান্ডই ছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ২১ শে জুন বলাকা ভবনে ছাত্রলীগের সভায় নিউক্লিয়াসের সদস্য ও ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরী প্রস্তাবক হিসাবে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ এর প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং প্রস্তাবটি পাশ হয়। ১৯৭১ সালে তৎকালীন রেসকোর্স মাঠে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্য সংযোজন করা হয় নিউক্লিয়াসের নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তে। বিপ্লবী পরিষদের সকল কর্মকান্ডের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছিল। আর এ সকল কর্মসূচির পরিকল্পনা প্রনীত হতো নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের সাংগঠনিক তত্ত্বাবধানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সাত হাজার সদস্য সংগৃহীত হয়।
নিউক্লিয়াসের নেতা কর্মীরা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংগঠনে পরিনত করে সমগ্র দেশের জনগনকে এই আন্দোলনে যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে সফলকাম হয়েছিলেন। নিউক্লিয়াসই সর্বপ্রথম একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। আরও অনেকেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু তাঁরা এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বাস্তব কোন কার্যক্রম গ্রহন করেছিলেন বলে কোন তথ্য-প্রমাণ দেখা যায়নি। সর্বপ্রথম নিউক্লিয়াসই স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহন করেছিল। ১৯৬৯ সালে কারামুক্তির পর বঙ্গবন্ধুকে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’ এর কর্মপদ্মতি, সংগঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে অবহিত করা হলে তিনি উজ্জীবিত হন এবং তখন থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন হন। ১৯৬৯ সালের দিকে এসে নিউক্লিয়াস নিজেদের পাশাপাশি জনগনকে সশস্ত্র করার চিন্তা থেকে সামরিক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ৭১ সালের মার্চে বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র ও বোমা বানানোর সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হতে থাকে। সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে কাজী আরেফ আহমেদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ৭১ সালের ১০ই মার্চ সায়েনস লেবরেটরী থেকে বোমা বানানোর উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। ১৭ তারিখে চট্টগ্রামের নিউক্লিয়াসপন্থীরা মাহফুজুর রহমান, ফাহিমউদ্দিন, আবদুল্লাহ আল হারুনের নেতৃত্বে পুলিশের উপস্থিতিতে সফলভাবে একটি বন্দুকের দোকান লুট করে প্রচুর বন্দুক হস্তগত করেছিল।
নিউক্লিয়াস সহজ সরল পদ্মতিতে গড়ে ওঠা কোন সংগঠন ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে নেতা মেনে এরা তাদের কাজ চালালেও বঙ্গবন্ধুর সাথে এদের সম্পর্ক সহজ সরল ছিল না। সম্পর্কটা ছিল দ্বান্দ্বিক। নীতিনির্ধারনী সভায় কর্মপন্থা ঠিক করে তারপরে বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতার্থে আনা হতো এবং তাঁর অনুমোদন নেয়া হতো। ছাত্রলীগের মধ্যে যারা স্বাধীনতা না চেয়ে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষপাতি ছিলেন তাদের সাথে নিউক্লিয়াসের মতবিরোধ হতো। তবে পরবর্তীতে ছাত্রলীগের উভয় ধারা স্বাধীনতার প্রশ্নে এক হয়েছিল। এটার কৃতিত্ব ছিল নিউক্লিয়াসের। এই নিউক্লিয়াস সদস্যদের একটা বড় অংশ স্বাধীনতার পরে একটা জাতীয় সরকার গঠনের আহবান জানালে তা প্রত্যাখ্যাত হয় আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক। ছাত্রলীগকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। ছাত্রলীগকে পরিচালনা করতো মূলতঃ নিউক্লিয়াস। আর নিউক্লিয়াসের মূল নীতিনির্ধারক হিসাবে সিরাজুল আলম খান ওরফে দাদার নাম আসবেই।মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দাদা ওরফে সিরাজুল আলম খানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম