দলীয় পদও গেল মুরাদের

20

পূর্বদেশ ডেস্ক

অডিও কেলেঙ্কারিতে মন্ত্রিত্বের পর জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের পদও হারিয়েছেন ডা. মুরাদ হাসান। সংসদ সদস্য পদ থাকবে কিনা তা নিয়ে চলছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করে বক্তব্য দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। এই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
এমন পরিস্থিতিতে ‘মা-বোনদের কাছে ক্ষমা’ চেয়েছেন সদ্য ‘পদত্যাগী’ তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ডা. মুরাদ হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) হারুনুর রশীদ বলেন, কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা তদন্তের জন্য মুরাদ হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। উনি যে ডিবির নাম ব্যবহার করেছেন, সেটা কেন করলেন, সেটাও প্রয়োজনে জানার জন্য আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি। পাশাপাশি যাদের সঙ্গে এই ধরনে ঘটনা ঘটেছে, প্রয়োজন হলে তাদেরও ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অভিনেত্রী মাহিয়া মাহি পবিত্র ওমরাহ পালন শেষে বুধবার (আজ) দেশে ফিরবেন। এরপর তিনি যদি কোনো মামলা করেন, বা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় র‌্যাব কার্যালয়ে ডেকে অভিনেতা মামনুন হাসান ইমনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন র‌্যাবের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে বলেন, অডিওর বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য তাকে ডাকা হয়েছে। এর বাইরে কিছু নয়। এর আগে দুপুরে ইমন নিজেই ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানাতে গিয়েছিলেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ই-মেইলযোগে মঙ্গলবার একটি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন সমালোচিত তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। সোমবার যখন দেশে তাকে নিয়ে তুমুল সমালোচনা হচ্ছিল, এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতারাও তাকে নিয়ে বিব্রত বলে জানাচ্ছিলেন, তারই এক পর্যায়ে তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যান বলে জানা যায়। প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, পদত্যাগপত্রটি তথ্য ও স¤প্রচার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।
সোমবার রাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবারের মধ্যে মুরাদ হাসানকে পদত্যাগ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ রাতেই মুরাদ হাসানকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বলে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী জানিয়েছিলেন।
অবশ্য পদত্যাগপত্রে ডা. হাসান লিখেছেন, ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে ইচ্ছুক তিনি। মঙ্গলবার থেকেই যেন তাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ দেয়া হয় বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন তিনি।
এরপর গতকাল বিকেলে তাকে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। দলীয় কার্যালয়ে এক ‘জরুরি’ সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলীয় ভাবমূর্তি বিনষ্ট, ‘অগঠনতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকান্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে’ মুরাদ হাসানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন। গঠনতন্ত্রে উনাকে সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে আমরা তার চূড়ান্ত শাস্তির সুপারিশ করবো। আমি আশা করি দল তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাই নেবে।
শাহবাগ থানায় অভিযোগ : সদ্য পদত্যাগ করা প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে গতকাল মঙ্গলবার শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। এই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
শাহবাগ থানার ওসি মওদুদ হাওলাদার বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা জিডি করেছি। এরপর এটি সাইবার ক্রাইম বিভাগে পাঠানো হবে।
ওসি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করে বক্তব্য দিয়েছিলেন মুরাদ। এ ঘটনায় জুলিয়াস সিজার তালুকদার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান নাহিদ রেইনস পিকচার্স নামে একটি ফেসবুক পেইজে লাইভ অনুষ্ঠানে এসে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এই বক্তব্যকে ‘বিকৃত যৌনাচার ও বিদ্বেষমূলক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সিজার তালুকদার।
সিজারের অভিযোগ, মুরাদ হাসান দেশের সর্বপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাচ্ছিল্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলের নারী শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা করেছেন।
মুরাদ হাসানের বক্তব্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিও তীব্র অশ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সিজার।

সংসদ সদস্য পদ যাবে না : দল থেকে বহিষ্কার করলে কী তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে? এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, আমাদের সংবিধানে আছে, কেউ যদি দল থেকে পদত্যাগ করেন তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। কিন্তু দল বহিষ্কার করলে তার সংসদ সদস্যপদ যাবে না। আবার কেউ যদি ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের বেশি দন্ডপ্রাপ্ত হন তাহলেও তার সংসদ সদস্য পদ যেতে পারে। আর উনি মস্তিস্ক বিকৃত বলে যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা করতে গেলে সরকারি কোনো হাসপাতালে মেডিকেল পরীক্ষার পর চিকিৎসকের সার্টিফিকেট লাগবে যে উনি একটা ‘পাগল’। তাহলে তার সংসদ সদস্য চলে যেতে পারে।

গুরু অপরাধে লঘু দন্ড : ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে কি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়? এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, উনি বেগম খালেদা জিয়া ও তার নাতনি সম্পর্কে ডিজিটাল ফোরাম ব্যবহার করে যেটা করেছে, সেটা তো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে চরমতম অপরাধ। উনি একজন নায়িকাকে যে ধরনের থ্রেট করেছেন রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করার কথা বলে এটা তো ফৌজদারি অপরাধ। তিনি রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে একজন নারীকে তুলে এনে ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছেন, এর চেয়ে বড় ফৌজদারি অপরাধ আর কী হতে পারে? তার পদত্যাগ তো কোনো শাস্তি না, তার তো জেলে থাকা উচিত। মন্ত্রিত্ব যাওয়া তার জন্য খুবই গুরু অপরাধে লঘু দন্ড।

শপথ ভঙ্গ হয়েছে : সদ্য পদত্যাগী প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের রায় আছে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রোধে সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে সংসদেরও একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত। সংসদ থেকে তো এখনো কোনো ধরনের বক্তব্য আসেনি। সংসদ সদস্যরা তো শপথ নেন, সংবিধানের উপরে। সেই শপথ তো ভঙ্গ হয়েছে।

সংসদ থেকে পদত্যাগ করা উচিত : মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলীও মনে করেন, উনি যে অপরাধ করেছেন সেটা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য। তিনি বলেন, সংবিধানের ১১১ ধারা অনুযায়ি উনার আচরণ একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভুক্তভোগী চাইলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। আমি চাই উনি পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করুন। তা না হলে উনার বিরুদ্ধে দলের উচিত হবে তাকে সংসদ থেকে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। সেটা না করলে জনগণের জন্য দুঃখজনক হবে। তা না হলে সমাজ বা জনগণই হয়ত উদ্যোগ নেবে।

অবশেষে ক্ষমা চাইলেন : তবে আগে অস্বীকৃতি জানালেও ডা. মুরাদ হাসান অবশেষে ক্ষমা চেয়েছেন। মঙ্গলবার তার নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে তিনি একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে লিখেছেন, আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি অথবা আমার কথায় মা-বোনদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মমতাময়ী মা, দেশরত্ন, বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার সকল সিদ্ধান্ত মেনে নেবো আজীবন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।