দবীর ঘটকের একদিন

18

বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার পর যখন দবীর রাস্তায় নেমে এলো তখনও হালকা বৃষ্টি। ছাতা মাথায়। প্যান্ট আগেভাগেই গুটিয়ে নিয়েছে পায়ের গোড়ালির অনেক উপরে। এরপরও স্যান্ডেলের কাদা উঠে আসছে কাপড়ে। এক হাতে ছাতা অন্য হাতে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়েছে। সাবধানেই হেঁটে চলছিল। কিন্তু কপালে দুর্ভোগ থাকলে যা হয়! ছোট্ট রাস্তাটা পার হয়ে এসেছে, বড় রাস্তার মুখে উঠবে এমন সময় কেউ যেন পেছন থেকে রুক্ষস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, এই যে ভাই, এই!
দবীর প্রথমে খেয়াল করেনি, মেয়েলি কন্ঠ শুনে মনে করেছে তাকে না আর কাউকে ডাকছে। কিন্তু দ্বিতীয় বার আবার একই সুরে আওয়াজ আসতে পেছন ফিরে তাকাল। দেখে, একজন চল্লিশের ঊর্ধ্বে মহিলা, তার বয়সিই হবে হয়তো, ঠিক নিশ্চিত নয়; মেয়েদের বয়স বোঝা যায় না। পাতলা চেহারা, লম্বাটে মুখ, পরনে দামি জামা, তার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। কী রকম লোক আপনি? কাদা ছিটিয়ে চলে যাচ্ছেন?
দবীর মনে করতে পারল না কখন সে এই মেয়েটির কাপড়ে কাদা লাগিয়েছে। তবু ভদ্রতার খাতিরে বলল, আপনার শরীরে আমি কাদা ছিটিয়েছি?
মহিলাটি বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, না, না, কাদা নয় বকুল ফুল ছিটিয়েছেন। আমার নাক বকুল ফুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে। কাপড়ে কাদা না লাগলে কি আমি মিথ্যা কথা বলছি?
দবীর বলল, দুঃখিত বোন, কিছু মনে করবেন না। রাস্তা ভর্তি কাদা পানি, নিজেই এতো সাবধানে হেঁটে যাচ্ছি! সম্ভবত আমার অজান্তেই লেগে গিয়েছে।
মেয়েটির এতে শান্ত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে আরও চেঁচিয়ে উঠে বলল, দুঃখিত মানে? কাপড়ে কাদা লাগিয়ে চলে যাবেন আর বলবেন দুঃখিত? ঘটকালি করেন বলে কি সব মেয়েদের মাথা কিনে নিয়েছেন?
দবীর অবাক হলো, সে যে ঘটক, তা এই মেয়েটি জানে, অথচ এই মেয়েটিকে চেনে না। অবশ্য চেনার কথাও নয়। সে নিজে খুব একটা মিশুকে লোক নয়। আদ্যোপান্ত সাদাসিধে, সরল, নির্বিরোধী মানুষ। কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। ঝামেলা ঝঞ্জাটও পছন্দ করে না। আজও সে ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করতেই চাইল। রাতের রাস্তায় মেয়েদের একা দেখলে ভয়ও হয়। কিছু মেয়েরা ব্যবসার জন্য রাতে রাস্তায় নামে। তাদের উদ্দেশ্য একা পুরুষকে জড়িয়ে ধরে টাকা আদায় করা। টাকা দিলে তো ভালো, না হলে চিৎকার চেঁচামেচি আর লোক জড়ো করা, তারপর ধর্ষক সাজিয়ে অসম্মান!
দৈনিক কাগজে এই জাতীয় ঘটনা দবীর পড়েছে অনেকবার। ঘটকালি জীবনে তার ক্লাইন্টদের একজনের মুখ থেকে এমন অভিজ্ঞতার কথাও শুনেছে সে। তবে এই মেয়েটি সেই দলের কেউ না হলেও সাবধানে থাকা ভালো। সে দেখেছে, কোনো কোনো মানুষ সহজেই কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলে, বদমেজাজি। এদের বেশি গুরুত্ব দিলে চলে না। সে তাই হাঁটতে আরম্ভ করল।
মেয়েটি তাতে ভীষণ ক্ষেপে গেল। তেড়ে আসার ভঙিতে বলল, এই যে! চলে যাচ্ছেন কেন? মেয়েদেরকে আপনি সম্মান করতেই জানেন না দেখছি! দেব না কি কানের নিচে এক থাপ্পড়!
দবীর সাধারণত রেগে যায় না। রেগে গেলেও বেশি হৈ চৈ করতে পারে না। কিন্তু এখন তার মাথায় রাগ উঠে গেল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। কিন্তু এখন কী করা উচিত, ভেবে পেল না।
এ দিকে রাস্তায় মানুষজন বেশ একটা সময় কাটানোর খোরাক পেয়ে তাদের দুজনকে ঘিরে ধরেছে। সে জানে পাবলিক সেন্টিমেন্ট সব সময় মেয়ে মানুষের পক্ষ নেয়। আর মেয়েটি যা বলছে, এ ক্ষেত্রে মেয়েটির কথাই লোকে ঠিক ভাবছে নিশ্চয়ই। সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে দোষী চোখে! দবীর চারদিকে তাকিয়ে অসহায় বোধ করল। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। সহসাই তার মাথায় একটি পাগলামি বুদ্ধি খেলে গেল। সে ছাতাটি বন্ধ করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে এসে বলল, বোন, আমি এত রকম করে আপনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি, তবু আপনি শান্ত হচ্ছেন না। কী করলে আপনি শান্ত হবেন বলুন? আমি যদি আপনার পায়ে ধরি তা হলে কি আমাকে ক্ষমা করবেন?
মেয়েটি বোধহয় ভাবতেও পারেনি দবীর মুখে যে কথা বলেছে তা বাস্তবে করতে পারবে। তাই একই রকম তেরিয়া ভাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু দবীর সময় না দিয়েই মেয়েটির পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মেয়েটি প্রথমে চুপ মেরে গেল। নির্বাক, হতভম্ব। কিন্তু পরক্ষণেই তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে শুরু করল। মুখে যে কী বলছে বোঝা গেল না। লাফাতে লাফাতেই মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দবীর আর কী করবে। দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে এলো। মনটা তার বড় খারাপ হয়ে গেল। রাতে শুয়ে শুয়েও মেয়েটির আচরণের কথাই ভাবতে থাকে। কেন মেয়েটি এমন করল তার সঙ্গে? মেয়েটি কি পাগল? না কি নিঃসঙ্গ? অথবা শ্বশুরবাড়িতে যাদের সান্নিধ্য আশা করা হয়, তাদের কাছ থেকে অপমান-লাঞ্ছনা আর দুর্ব্যবহার পেতে পেতে সবকিছুতেই পদাঘাতের আশঙ্কা করেন? সত্যি মানুষ বড় বিচিত্র।
পরের দিন বাড়ি থেকে বের হলো না দবীর। বিয়াল্লিশ বছর বয়সেও বিয়ে করেনি সে। সারাদিন তার একার সংসারের অনেক কাজই করল। কিন্তু ঘুরে ফিরে গত সন্ধ্যার ঘটনাটাই যেন তাকে তাড়া করছিল। প্রবল কৌতুহল হচ্ছিল জানতে, মেয়েটি কেন তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করল!
দুপুরে খেয়ে একটা ছোট্ট ভাতঘুম দিল সে। ঘুমের ভেতরে স্বপ্নে দেখল সেই মেয়েটির খোঁজে বের হয়েছে। কিন্তু কোথায়ই বা খুঁজবে! কালকের ঠিক সেই জায়গাটা আসতেই তার মনটা কেমন কুঁকড়ে গেল। ওই মহিলা-মেয়েটি আজকেও দাঁড়িয়ে! কাছে গিয়ে সে কী বলবে? আবার এক চোট ঝামেলার সৃষ্টি হবে না তো? তার চেয়ে দরকার নেই, স্বপ্ন থেকে ফিরে আসা ভালো। কী অবাক কান্ড, ঘুমের ভেতরেও কালকের ঘটনাটা এসে উপস্থিত হয়েছে!
ঘুম ভাঙার পর আর এক বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল তার জন্য। ঘরের ভেতর একটি ছেলে বসা। তার মুখ অচেনা। ছেলেটি তাকে জেগে উঠে বসতে দেখে এগিয়ে এলো। ক্লাইন্ট এলে সাধারণত অফিস ঘরেই বসে। বাইরের বারান্দা ঘেষে দবীরের অফিস ঘর। পাত্র-পাত্রী নিয়ে আলোচনা সেখানেই হয়। শোবার ঘর পর্যন্ত কেউ আসে না। দবীর বলতে যাচ্ছিল বারান্দায় গিয়ে বসুন ছেলেটি বলে উঠল, ভাই, আমার আপার সঙ্গেই গতকাল আপনার ঝামেলা হয়েছিল।
দবীর ছেলেটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। সে ভাবল, আবার কী ঝামেলা হয়। কিন্তু সে অবাক হলো ছেলেটির ব্যবহারে। ছেলেটির চোখে বিস্ময় আর মুগ্ধতা মাখামাখি। সে বিছানায় বসে বলল, আপনাকে তো আমি চিনি। আমাদের পাশের পাড়ারই লোক আপনি। দেখুন দেখি কী অবস্থা!
দবীরের জীবনে অভিজ্ঞতার ভান্ডার অফুরান, কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা কোনো দিন হয়নি। সে কিছু বলার আগেই ছেলেটি তার হাত ধরে টানতে থাকল, আপনাকে একবার আমাদের বাড়ি আসতে হবে।
বিস্ময়ে দবীরের মুখে কথা এলো না। ছেলেটি বলল, ভাই, আমি আমার আপাকে নিয়ে হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম। আপার স্বভাবটা বরাবরই একটু বদমেজাজি। অবশ্য তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কারণ আপা ছোট বয়স থেকেই খুব সুন্দরী, যারা ভীষণ সুন্দর তাদের ভেতরে একটা অহংকার থাকে। আমার বাবা সুদর্শন পুরুষের সঙ্গেই আপার বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু চার বছর না যেতেই সেই বিয়ে টিকল না। নেশাখোর স্বামী দিনরাত আপার ওপর নির্যাতন করত। বাবার মৃত্যুর এক বছর আগেই আপা ডিভোর্স নিয়ে এখন আমাদের সঙ্গে আছেন। তার একজন সাত বছরের মেয়েও আছে। ডিভোর্সের পর থেকেই আপার মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক নয়। উগ্র আচরণ করে বসেন সবার সঙ্গেই। মাঝে মাঝে এমন এক-একটা কান্ড ঘটান, যা মেনে নেওয়া যায় না। মা-বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন আপার সব জুলুম হাসিমুখে সহ্য করেছেন। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর আপার ব্যবহার যেন সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছে। কথায় কথায় ঝগড়া-অশান্তি, পান থেকে চুন খসলে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া। জানেন, আপা আমার বউকে বলে যে, আমাকে ডিভোর্স দিতে। পুরুষ মানুষে বিশ্বাস নেই। আমি না কি অন্য মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে বেড়িয়ে বউকে ঠকাচ্ছি- এ সব কথা দিনরাত আমার বউকে কানপড়া দেয়। বলুন তো, এত অশান্তি আমি ভাই হয়ে সহ্য করলেও আমার বউ কী করে সহ্য করে? গত রাতে আমি মোবাইল ফোনে কাজ করার সময় আমার বউকে ডেকে এনে বোঝাচ্ছিল- আমি কোনো মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতেই ফোন হাতে রাখি। আমার বউ বিশ্বাস করে ফেলল, চরম অশান্তি জুড়ে দিল! তারপর রাগ করে বাপের বাড়ি বেরিয়ে গেল। আপার সঙ্গে আমার তুমুল ঝগড়া হলো, রাগের মাথায় তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে যে সে ঝামেলা করবে ভাবতে পারিনি। তবে আমি অবাক হচ্ছি যে, গত কালের ঘটনার পর থেকে আপার মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেছে।
দবীর বলল, কী রকম পরিবর্তন?
যে মানুষ সব সময় বাড়ির সকলকে তটস্থ করে রাখত, সে কালকের পর থেকে অদ্ভুত রকম শান্ত হয়ে গিয়েছে। আজ সকালে আমার শ্বশুরবাড়ি সে নিজে গিয়ে আমার বউয়ের হাতেপায়ে ধরে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে। যেন আমার সেই অশান্তি করা বোন নয়, অন্য কেউ! ভাই আপনি কাল সন্ধ্যায় কী করেছেন, তা আমি শুনেছি। কিন্তু তা যে আপার মনে এত গভীর ভাবে দাগ কেটে যাবে ভাবতে পারিনি। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি আপনাকে খুঁজেছি অনেক। কিন্তু কেউ আপনার ঠিকানা বলতে পারেনি। তবে আমি আপনাকে শুধু কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য খুঁজছিলাম না!
দবীর অবাক হওয়ার মাত্রা বেড়েই চলেছিল। সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
ছেলেটি বলল, আপা যতই আমাদের সঙ্গে ছেলেমানুষী করুন, ওর কষ্ট দেখে তো ভাই হয়ে চুপ করে থাকতে পারি না।
কিসের কষ্ট?
যে মানুষ সারাদিন সকলকে অতিষ্ঠ করে রাখতেন, তিনি যদি হঠাৎই চুপ হয়ে যান, কারও সঙ্গে একটা কথা পর্যন্ত না বলেন, তা হলে কি সেটা কষ্টের ব্যাপার নয়? আপাকে আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে কোনো পুরুষমানুষকে বিশ্বাস করে না। আমি চাই আপনি আমার আপার জন্য ভালো একটি পাত্রের সন্ধান করুন, আপাকে আবার বিয়ে দিতে চাই।
দবীর বলল, আমি পাত্র খুঁজে এনে দিলেই কি উনি বিয়ে করবেন?
নিশ্চয়ই করবেন। আপনি তাকে বোঝাবেন। সম্ভবত আপনার কালকের আচরণে আপা নিজেকে খুবই ধিক্কৃত ভাবছেন। আপনি বললে উনি নিশ্চয়ই স্বাভাবিক আচরণে ফিরে যাবেন এবং বিয়েতে রাজি হবেন।
দবীর একটু থমকে দাঁড়াল। ছেলেটির বোনের উপর তিনি মনে মনে রুষ্ট হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কখন যেন সেই রাগ মিলিয়ে গিয়েছিল। সে জীবনে কারও ক্ষতি করেনি, উপকারও করেনি। কিন্তু এখন যখন ছেলেটি তাকে এমনভাবে বলছে, সে এক অদ্ভুত আবেগে আপ্লুত হলো।
সে ছেলেটির সঙ্গে তাদের বাড়ি এলো। দেখল সেই মেয়েটি কেমন জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসে আছে। আগের দিনের সেই তেজ আর নেই, তার বদলে চোখে খেলা করছে বিকেলের মøান আলো। তাকে দেখে মেয়েটি চোখ তুলে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর ইঙ্গিতে বসতে বলল।
দবীর বসল। ভেবেছিল অনেক কিছু বলবে। অনেক বোঝাবে। কিন্তু কী যে হল তার, কিছুই বলতে পারল না। চুপচাপ বসেই থাকল। দেখল মেয়েটি তার দিকে তাকিয়েই আছে। দুজনের মধ্যে কী ভাবে যেন আদানপ্রদান হয়ে চলেছে কথার স্রোত। সে সব কথা কেউ শুনতে পায় না, কেউ বুঝতেও পারে না। যখন বিকেলের ম্লান আলো এসে চোখে লাগে, সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে ছায়া ফেলতে চেষ্টা করে জীবন-যাপনের লগ্নে, তখনই বুঝতে পারে মানুষ।
দবীর অনেকক্ষণ বসে থাকল। তারপর এক সময় মেয়েটির দুই হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে চাপ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সেই সময় কানে এলো, মেয়েটি তাকে ডাকছে, এই যে শুনুন, আমাকে আপনার সঙ্গে আপনার বাড়ি নিয়ে যাবেন?