দখলদারদের বিরোধেই ‘আগুন লাগানোর খেলা’

44

জমি সরকারি, দখল প্রভাবশালীদের। তারা কয়েকশ বস্তিঘর ও দোকান তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। দখলদার মালিকরা অগ্রিম হিসেবে পেয়েছেন কয়েক লাখ টাকা। প্রতি মাসে ভাড়া আদায় করেন আরো কয়েক লাখ টাকা। দখল নিয়ে মালিকদের মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে উচ্ছেদ ভীতিও। এর জের ধরেই বারবার আগুন লাগানোর খেলায় মেতে উঠছে বিরোধী পক্ষগুলো।
কর্ণফুলী পাড়ে চাক্তাই ভেড়া মার্কেট এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত পাঁচটি বস্তি। প্রতিটি বস্তিতে দেড়শ থেকে দুইশ ঘর রয়েছে। চার মাস আগে গত ১৬ ফেব্রæয়ারি রাতে আগুনে পুড়ে যায় একটি বস্তির প্রায় দুইশ ঘর। সে সময় দগ্ধ হয়ে মারা যান ৯ জন। গত বৃহস্পতিবার সকালে আরেকটি বস্তিতে আগুন লাগে। দুইটি বস্তি পাশাপাশি। আগুনে ১৬৫টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুই বস্তিতে আগুন নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। আগুনের ধরনও একই। তবে একটি রাতে, আরেকটি দিনে। দ্বিতীয় বস্তিতে যদি আগুন রাতের বেলায় লাগত তাহলে প্রাণহানী ঘটত বলে স্থানীয়দের ধারণা।
জানা যায়, বেড়া মার্কেট বস্তির মালিক কথিত যুবলীগ নেতা আকতার, ফরিদ, সাত্তার, আবু তৈয়ব, আজিজ ও কবির। তারা সকল বস্তির নিয়ন্ত্রক।
এলাকাবাসী জানান, একসময় এসব বস্তির মালিক ছিলেন জসিম উদ্দিন প্রকাশ রোহিঙ্গা জসিম। সরকারি জমি দখল করে বাস্তুহারা বস্তিঘর নির্মাণ করে কোটিপতি হয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। একই কায়দায় বেড়া মার্কেট বস্তি দখল করে যুবলীগ নেতা আকতারও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সরকারি জায়গা দখল করে দুইজনই গড়ে তুলেছেন দুই সাম্রাজ্য। দখলদারিত্ব নিয়ে জসিম ও আকতারের মধ্যে বিরোধ ছিল। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জসিম কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন। আকতার তার বিরোধিতা করেছিলেন। তার দ্ব›েদ্বর জের ধরে জসিম যুবলীগ নেতা আকতারকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আঘাত করেন। এক পর্যায়ে জসিম পালিয়ে যান।
দেখা যায়, ভেড়া মার্কেট এলাকায় রয়েছে কয়েক একর সরকারি জমি। এ সরকারি খাস জমি দখল করে চাক্তাই ভেড়া মার্কেট বস্তি গড়ে তোলা হয়। আকতারের নেতৃত্বে সরকারি জমি দখল করে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে কলোনি নির্মাণ করা হয়েছে। ৩৫ বছর ধরে সরকারি জমি অবৈধভাবে দখল করে রাখা হয়েছে। আকতার ছাড়াও ৩০ ব্যক্তি সরকারি জমিতে অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন ওই বস্তিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আকতার সিন্ডিকেট ওই এলাকায় কয়েক একর জমি দখল করে নেন। তিনি কিছু জমি প্লট তৈরি করে বিক্রিও করেন। প্রতি প্লট তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। বাকি জমিতে বস্তিঘর তৈরি করেন তিনি। আকতার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৫ শতাধিক বস্তিঘর। প্রতি ঘর ভাড়া দেয়ার সময় ৫ থেকে ১০ হাজার করে অগ্রিম নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। প্রতি ঘর থেকে মাসে এক থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়।
জানা যায়, বস্তির মালিকদের মধ্যে কিছুদিন ধরে বিরোধ দেখা দেয়। দখলদারিত্ব নিয়েই এ বিরোধ। বিশেষ করে আকতারের সাথে অন্য শরিকদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। সব শরিক জমি ও বস্তির সমান অংশ চাইলে দ্ব›দ্ব সৃষ্টি হয়। আকতার তাদের সমান অংশ দিতে রাজি নয়। আদায়কৃত ভাড়ার একটি বড় অংশ আকতার রেখে দেন। সামান্য অংশ দেন শরিকদের। শরিকরা তা মানতে রাজি নয়। এনিয়ে তাদের মধ্যে কয়েকদফা ঝগড়া বিবাদও হয়েছে বলে। এরই জের ধরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটতে পারে।
অপর একটি সূত্র জানায়, গত ফেব্রæয়ারি থেকে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কর্ণফুলী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে বস্তিঘর উচ্ছেদের নোটিশও দেয় জেলা প্রশাসন। উচ্ছেদ শুরুর কয়েকদিন পরই প্রথম বস্তিতে আগুন লাগে। সেসময় বলা হয়েছিল উচ্ছেদ থেকে বাঁচতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। বৃহস্পতিবার পুড়ে যাওয়া বস্তিও উচ্ছেদ তালিকায় রয়েছে। এ বস্তিও উচ্ছেদ থেকে রক্ষায় আগুন লাগানো হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও তদন্ত কমিটির প্রধান মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করব আমরা। কিভাবে আগুন লাগল, নেপথ্যে কোন কারণ আছে কিনা সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখা হবে। তদন্ত শেষে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।’ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি তদন্ত শেষ করবেন বলে জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভেড়া মার্কেট নির্মাণের পর ১৯৯৮ সালের দিকে কসাই কাজ করতেন আকতার হোসেন। সেই থেকে ‘কসাই আকতার’ হিসেবে পরিচিত। ২০০৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আকতার রাতারাতি আওয়ামী লীগ বনে যান। পরবর্তীতে ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি হন। সেই থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। বস্তিঘর নির্মাণের পর আকতারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে চাক্তাই ভেড়া মার্কেট শ্রমজীবী কল্যাণ সমবায় সমিতি। আকতার ওই সমিতির সভাপতি।
স্থানীয়রা জানান, ভেড়া মার্কেটের বস্তিতে অসামাজিক কার্যকলাপও চলে সমানতালে। মাদক ব্যবসা, জুয়ার আসর বসে প্রতি রাতে। আকতার সিন্ডিকেট এ আসর বসায়। বাকলিয়া, কোতোয়ালী ও চাক্তাই পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা জুয়ার আসর থেকে মাসোহারা ও দৈনিক ভিত্তিতে ভাগ পায়।
এদিকে ঘরহারা লোকজন মানবেতর দিন কাটছেন। কোন পরিবারেই অবশিষ্ট কিছু নেই। রান্নার ডেকছি, কাপড় চোপড় পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্থানীয় কাউন্সিলর নুরুল হক ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম পরিবারগুলোর মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।