থামছে না শিশুর ওপর পৈশাচিক বর্বরতা

39

তুষার দেব

নগরীতে শিশুকন্যার উপর একের পর এক পৈশাচিক বর্বরতার ঘটনা ঘটছে। কতিপয় পাষন্ড তাদের জঘন্য লালসার শিকারে পরিণত করছে নিষ্পাপ শিশুদের। বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ করার পর অপরাধ আড়াল করতে কেড়ে নেয়া হচ্ছে শিশুদের প্রাণ। লোভনীয় খাবার কিংবা অর্থের প্রলোভনে ফেলে শিশুকন্যাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নির্জন স্থানে। নির্মম ও পাশবিক অত্যাচারের পর শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। এসব ঘটনায় অভিভাবক মহলে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছে।
এদিকে, শিশুর ওপর সংঘটিত পাশবিক অত্যাচার ও হত্যাকান্ডে জড়িতদের বেশিরভাগই পুলিশের জালে ধরাও পড়ছে। আদালতে বিচারের পর এ সংক্রান্ত মামলার রায়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দেয়া হচ্ছে। তবুও নির্বৃত্ত করা যাচ্ছে না বর্বর পাষন্ডদের। একটি ঘটনার পর কদিন যেতে না যেতেই ঘটছে আরেকটি ঘটনা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে যদি অপরাধীদের মনে নির্মম পরিণতির ভয় সঞ্চার করা সম্ভব হত, তাহলে নতুন করে সমাজে আর এ ধরনের রোমহর্ষক ঘটনা ঘটত না। এ ধরনের ঘটনা নির্মূল করতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজে ফিরিয়ে আনতে হবে নৈতিক মূল্যবোধের নিয়মিত চর্চা। শিশুর ওপর এ ধরনের বর্বরতাকে কিছুতেই বাড়তে দেয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আ.স.ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, নগরীতে সংঘটিত শিশু ধর্ষণ ও হত্যাসহ যে কোনো অপরাধের ব্যাপারে পুলিশ সবসময় সতর্ক ও তৎপর রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বন্দরের পোর্ট কলোনি ও জামালখানের ব্রিজ গলিতে দুটি শিশুর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ঘটনার পরপরই দ্রæততম সময়ের মধ্যে হত্যাকান্ডের রহস্যভেদ এবং জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলন এবং তাতে সকলের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত নারী ও শিশু ধর্ষণের পর হত্যার মত বর্বরোচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে উদ্বেগজনক বলেই মনে করেন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষের নৈতিক চরিত্রে মড়ক লাগা আর মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি পূর্বদেশকে বলেন, বর্তমান সমাজ নৈতিকতার বিপরীত স্রোতধারায় পরিচালিত হচ্ছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষের মনোবৃত্তিতে ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন। সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসন বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নৈতিক চরিত্র গঠনের কোনও চর্চাই এখন আর চোখে পড়ে না। এতে করে সর্বক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা বিস্তার লাভ করছে। ভোগবাদী জীবনের নেশায় বিভ্রান্তির অন্ধকার গলিপথে দৌড়াতে গিয়ে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের সহজাত কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কার্যকলাপ। এ থেকে পরিত্রাণের কার্যকর উপায় খোঁজা জরুরি।
চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুর ওপর পাশবিক নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। তিনি বলেন, শিশুর ওপর নির্মম বর্বরতার পুনরাবৃত্তি অভিভাবদের মনে আতঙ্ক তৈরি করছে। নারী ও শিশু কন্যার ওপর পাশবিকতার ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সারা দেশে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বর্বরোচিত এই অপরাধের মূলোৎপাটনের উপায় খুঁজে বের করাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। কঠোর আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি ধর্ষণবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের গত নয় মাসে নগরীতে বেশ কয়েকটি শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ অক্টোবর বিকালে নগরীর জামালখান সিকদার হোটেলের পাশে ব্রিজ গলির বড় নালা থেকে মারজান হক বর্ষা (৭) নামে শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ২৪ অক্টোবর বিকালে ওই এলাকায় নিজেদের ভাড়া বাসা থেকে বিস্কুট কিনতে বের হওয়ার পর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। নিহত বর্ষা নগরীর কুসুমকুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। তার বাবা আব্দুল হক মারা গেছেন। মা ঝর্ণা বেগম ও সৎ বাবা মোহাম্মদ ইউছুপের সঙ্গে ব্রিজ গলির বাসায় থাকতো। তার আরও দুই বোন আছে। লাশ উদ্ধারের পর তার মা বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ লাশ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ২৪ অক্টোবর দিবাগত রাতেই হত্যারহস্য উন্মোচন ও আসামিকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়। পাড়ার মুদির দোকান শ্যামল স্টোরের কর্মচারি লক্ষণ দাশ (৩০) একশ’ টাকা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে চিপস কিনতে যাওয়া শিশু বর্ষাকে গলির একেএম জামালউদ্দিনের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকা গুদামে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে পাশের বড় নালায় ফেলে দেয়। লাশভর্তি ট্রেডিং কর্পোরেশনের (টিসিবি) সীলযুক্ত বস্তার সূত্র ধরে সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ ব্রিজ গলির মুখে থাকা মুদি দোকান শ্যামল স্টোর থেকে আসামি লক্ষণ দাশকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন ধর্ষণ ও হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার ৩৬ দিন আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বন্দর থানাধীন আবাসিক পোর্ট কলোনির আট নম্বর রোডের একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে সাত বছর বয়সী শিশু সুরমা আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের পর থেকেই পুলিশ সন্দেহভাজন এক রিকশাচালকের খোঁজে মাঠে নামে। বিরিয়ানি খাওয়ানোর প্রলোভনে ফেলে ওই রিকশাচালক শিশু সুরমা আক্তারকে রিকশায় তুলে নিয়ে গেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। শিশু সুরমা আক্তার ধর্ষণ ও হত্যা রহস্য উদঘাটনে পুলিশ বন্দর থানা, হালিশহর থানা এবং ডবলমুরিং মডেল থানা এলাকায় লাগানো শতাধিক সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে। ঘটনাস্থলের আশপাশেসহ বিভিন্ন এলাকার রিকশা গ্যারেজে গিয়ে অন্তত পাঁচ হাজার রিকশাচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা করে ঘাতককে শনাক্ত করা হয়। ঘটনার ২৬ দিন পর গত ১৩ অক্টোবর ভোরে ডবলমুরিং থানার বেপারীপাড়া এলাকার একটি রিকশা গ্যারেজের সামনে থেকে বন্দর থানা পুলিশ সুরমা ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িত সেই রিকশাচালক ওসমান হারুন মিন্টুকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি ওসমান মিন্টু জানিয়েছেন, বিরিয়ানি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকালে হালিশহর কে বøকে ‘স্বপ্ন সুপার শপের’ পাশ থেকে শিশু সুরমা আক্তারকে তার রিকশায় উঠায়। বড়পুল এলাকায় নিয়ে একটি দোকান থেকে কিনে বিরিয়ানি খাওয়ায়। এরপর পোর্ট কলোনির আট নম্বর রোডের মাথায় পরিত্যক্ত ঘরে নিয়ে শিশু সুরমা আক্তারকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এসময় শিশু সুরমা যন্ত্রণায় চিৎকার-চেঁচামেচি করলে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে যায়। এর কয়েক মাস আগে ১৩ মার্চ নগরীর হালিশহর থানা এলাকায় পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতিবেশী আলমগীর মিয়ার বাসার খাটের নিচ থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ওই স্কুলছাত্রীর লাশ উদ্ধার করে। পরদিন ওই স্কুলছাত্রীর বাবা হালিশহর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। মামলার দু’দিন পর গত ১৬ মার্চ সকালে র‌্যাব-৭ এর একটি দল মানিকগঞ্জের ধামরাই এলাকা থেকে ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িত আলমগীর মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। আলমগীর মিয়া নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার বাসিন্দা। শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে মানিকগঞ্জে তিনি আত্মগোপন করেন। গ্রেপ্তারের পরদিন গত ১৭ মার্চ বিকালে আসামি আলামগীর মিয়া অপরাধের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ঘটনার দিন সকালে ওই স্কুলছাত্রী কোচিং শেষে বাসায় আসে। তখন আলমগীর তাকে বাসয় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে শিশুটির গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশটি বাসার খাটের নিচে রাখে। এরপর আলমগীর তার স্ত্রীর কর্মস্থলে তাকে জানায়, এলাকার একজনের সঙ্গে মারামারি হয়েছে। বাসায় পুলিশ আসবে। তাই বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে। এরপর তারা চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যায়।