থানা বাড়লে কি অপরাধ কমে?

70

মনিরুল ইসলাম মুন্না

নগরীতে ১৬ থানা নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। পাশাপাশি নতুন আরও চার থানার কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায়। নতুন করে চারটি থানা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে সিএমপি। এখন থানার সংখ্যা বাড়লে অপরাধ কি কমানো যাবে বা নিয়ন্ত্রণ করা কি সম্ভব- এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে নতুন নতুন স্থাপনা, রাস্তা-ঘাট ও কর্মপরিধি বাড়ছে। সেগুলো নজরদারি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে থানার সংখ্যা বাড়ানো খারাপের কিছু নয়। তবে আইন প্রয়োগে পুলিশের শৈথিল্য ও এক চোখা নীতি অপরাধের মাত্রা বাড়াতে অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা করছে।
এই বিষয়ে অপরাধ বিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে যে থানার সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তা যুগোপযোগী উদ্যোগ। থানার সংখ্যা যত বেশি হবে তত মনিটরিং বাড়বে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের নজরদারির জন্য পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। যার কারণে অপরাধও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এখন থানা বাড়লে কিছু এলাকা যুক্ত হওয়ার পর নজরদারির আওতায় চলে আসবে।
তিনি আরও বলেন, নগরীতে কাজের সন্ধানে অনেক লোকজন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন। কিন্তু এসব লোকজন আদৌ জঙ্গী কি না, তারা কোনো অপরাধ ঘটাতে পারে কি না এটা কেউ জানে না। এখন যদি নতুন থানা হয়, তাদের মধ্যে একধরণের ভীতি তৈরি হবে। আর কোনো অপকর্ম করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলবে। তবে থানা করতে গেলে ভালমত জরিপ করে থানা এলাকা নির্ধারণ করতে হবে। জনসংখ্যা ও আয়তনের পাশাপাশি অপরাধপ্রবণ এলাকা জরিপ করে নির্ধারণ করা উচিত হবে। তাহলে সে থানার সুফল পাওয়া যাবে।
কলেজ শিক্ষক মোন্তাকিম হোসেন বলেন, অপরাধীরা নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্য নতুন অপরাধ করছে। এছাড়া তারা নতুন নতুন কিছু মাদক আবিষ্কার করছে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও অজানা। সেক্ষেত্রে তাদের যে থানাগুলো রয়েছে, তাতে তাদের লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়িয়ে পৃথিবীর উন্নত দেশের মত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে নজর রাখলে ভাল হবে। তবে থানার সংখ্যা বাড়বে ঠিকই, পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। থানা করে রেখে যদি এলাকার তুলনায় জনবল কম দেয় সেক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেদিকে যেন নজর দেয়, তার অনুরোধ থাকবে সংশ্লিষ্টদের প্রতি।
নতুন থানা হলে এর সুফলও অনেকে ভোগ করবেন। জেলা পুলিশের অনেক এলাকা আছে, যা সিএমপি’র নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার সাথে লাগোয়া কিন্তু থানা থেকে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। নতুন থানা সেক্ষেত্রে উপকৃত করবে। পাশাপাশি অপরাধও নিয়ন্ত্রণ হবে বলে মনে করেন অনেকে।
পটিয়া থানার কোলাগাঁও এলাকার বাসিন্দা ও ব্যাংক কর্মকর্তা মো. ইয়াছিন আরাফাত বলেন, আমাদের এলাকার অনেক অপরাধীদের মনে পুলিশের ভয় তেমন একটা নেই। পটিয়া থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটারের মত। অপরাধের বিষয়ে কেউ অভিযোগ দেয়ার পর পটিয়া থেকে পুলিশ আসতে আসতে অপরাধীরা তাদের কাজ সেরে আরামে ঘুমাতে পারে। এখন যদি থানা হয় তাহলে পুলিশি তৎপরতা বাড়বে। আর অপরাধীরা আতঙ্কে থাকবে। সাধারণ মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে।
হাটহাজারী এলাকার চিকনদন্ডী এলাকার বাসিন্দা চৌধুরী মাহবুব বলেন, আমার বাড়ি থেকে হাটহাজারী থানার দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটারের মত। একটা জিডি করতে গেলেও আমাদের অনেক ভোগান্তি পেতে হয়। শুনেছি আমার এলাকাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থানার আওতায় পড়বে। এতে আমরা উপকৃত হবো।
জানা গেছে, নগরীর নিকটবর্তী জেলা পুলিশের আওতাধীন তিনটি থানার বেশ কিছু অংশকে নিজেদের আওতাভুক্ত করতে চায় সিএমপি। এসব এলাকায় নতুন করে চারটি থানা গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সিএমপির পক্ষ থেকে। আর এসব হয়ে গেলে ১৬ থানা নিয়ে চলা সিএমপিতে শিগগরিই শুরু হবে নতুন করে আরও চার থানার কার্যক্রম। এ নিয়ে ২০টি থানার পাশাপাশি জেলা পুলিশের থানা ভেঙে নতুন করে চারটি থানা যুক্ত হলে সিএমপিতে মোট থানার সংখ্যা দাঁড়াবে ২৪ টিতে।
খুব শীঘ্রই চালু হতে যাওয়া থানাগুলো হলো- হাটহাজারীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থানা ও মদুনাঘাট থানা, সীতাকুÐের ফৌজদারহাট থানা এবং পটিয়ার কালার পোল থানা। এর মধ্যে হাটহাজারী থানার ১৩ নম্বর দক্ষিণ মাদার্শা, ১৪ নম্বর শিকারপুর, ১৫ নম্বর বুড়িশ্চর ইউনিয়ন নিয়ে হবে মদুনাঘাট থানা। একই থানার অধীনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড, ১১ নম্বর ফতেপুর ও ১২ নম্বর চিকনদÐী ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থানা। সীতাকুন্ড মডেল থানা এলাকার ৮ নম্বর সোনাইছড়ি, ৯ নম্বর ভাটিয়ারি ও ১০ নম্বর সলিমপুর ইউনিয়নের আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত হবে ফৌজদারহাট থানা। পটিয়া থানার ৪ নম্বর কোলাগাঁও, ৫ নম্বর হাবিলাসদ্বীপ, ৬ নম্বর কুসুমপুরা ও ৭ নম্বর জিরি ইউনিয়ন নিয়ে হবে কালারপোল থানা।
ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে সিএমপির উত্তর বিভাগে ‘মোহরা থানা’, পশ্চিম বিভাগে ‘কাট্টলী থানা’, বন্দর বিভাগে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল উত্তর থানা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু টানেল দক্ষিণ থানা’। শীঘ্রই এসব থানার কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে।
সিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, জেলা পুলিশের থানা থেকে দূরত্বের কারণে নগরের কাছাকাছি এলাকার যেসকল মানুষ পুলিশের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মূলত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নতুন চারটি থানা জেলা থেকে সিএমপির আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আয়তন বাড়িয়ে নতুন চারটি থানা গঠনের বিষয়ে চলতি মাসের শুরুর দিকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সংশ্লিষ্ট কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নতুন এই প্রস্তাব বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই শেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হয়ে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটিতে (নিকার) পাস হলেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে থানার কার্যক্রম।
সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর পূর্বদেশকে বলেন, জেলা পুলিশের থানা থেকে দূরত্বের কারণে নগরের কাছাকাছি এলাকার অনেক মানুষ পুলিশের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও জনগণকে পরিসেবা দেয়া স্বাভাবিকভাবে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নতুন চারটি থানা জেলা থেকে সিএমপির আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর প্রস্তাবিত থানাগুলো অপরাধ কমাতে এবং জনগণকে সহজে সেবা দিতে কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করবে।
জানা যায়, ৩০ হাজার ৪৬৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনজুড়ে চট্টগ্রাম মহানগরে ১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের আওতায় ছয়টি থানা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিল সিএমপি। বর্তমানে ৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনজুড়ে সিএমপির কার্যক্রম বিস্তৃত। গত ২০০০ সালে থানার সংখ্যা আরও ছয়টি বাড়িয়ে ১২টিতে উন্নীত করা হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালে মহানগর এলাকায় আরও চারটি নতুন থানা স্থাপনের মাধ্যমে মোট ১৬টি থানায় বিভক্ত হয়ে সিএমপির কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এরপর থেকে নানা সময়ে নতুন থানা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। চট্টগ্রাম মহানগরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে আনুমানিক ৭৫ লাখ মানুষের বসবাস হলেও সেই সাত হাজার পুলিশ সদস্যকেই সামলাতে হচ্ছে পুরো নগরের নিরাপত্তা। এরমধ্যে নগরের বাইরে কর্ণফুলী উপজেলাকেও সামলাতে হয় সিএমপিকে।
বর্তমানে সিএমপির চার বিভাগের অধীনে পরিচালিত থানাগুলো হচ্ছে- উত্তর বিভাগে চান্দগাঁও, খুলশী, পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ। দক্ষিণ বিভাগে কোতোয়ালী, বাকলিয়া, চকবাজার ও সদরঘাট। পশ্চিম বিভাগে পাহাড়তলী, হালিশহর, আকবরশাহ ও ডবলমুরিং। বন্দর বিভাগে বন্দর, পতেঙ্গা, কর্ণফুলী ও ইপিজেড থানা। এর বাইরেও চার বিভাগে ভাগ হয়ে ডিবি, এসবি, পিএমও, ট্রাফিক, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের মত অন্যান্য বিভাগগুলোর কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে।