তৎপর হয়ে উঠেছে ‘মৌসুমি’ অপরাধীরা

42

পবিত্র ঈদুল-আযহাকে সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছে ‘মৌসুমি’ অপরাধীরা। অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, গামছাপার্টি ও টানাপার্টিসহ নানা নামে পরিচিত সংঘবদ্ধ এসব অপরাধচক্রের সদস্যদের টার্গেটের শীর্ষে রয়েছে কোরবানির পশুর হাট ও বিভিন্ন ব্যাংকের শাখাগুলো। এছাড়া, বাস ও ট্রেন স্টেশনসহ জনসমাগমস্থলকে ঘিরেও সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে চক্রগুলোর সদস্যরা। টার্গেট করা ব্যক্তিকে অনুসরণের এক পর্যায়ে ঘুমের ওষুধ মেশানো জুস খাইয়ে কিংবা চোখে মলম লাগিয়ে সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়াই তাদের একমাত্র কাজ। নগর পুলিশ ইতিমধ্যে এ ধরনের দু’টি গ্রæপের সর্দারসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। নগর পুলিশের কমিশনার মো. মাহবুবর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘বড় উৎসবগুলোকে সামনে রেখে মানুষের বাড়তি ব্যস্ততা ও আর্থিক লেনদেনকে টার্গেট করে এক ধরনের পেশাদার অপরাধীর তৎপরতা আমরা দেখে থাকি। সম্প্রতি কয়েকজন এ ধরনের অপরাধ চক্রের কবলে পড়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়ার পর থানা ও ডিবিসহ পুলিশের সবকটি ইউনিটকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়। এরমধ্যে কয়েকজন ধরাও পড়েছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা ব্যক্তি ও এলাকাগুলোর আশপাশে নজরদারি করা হচ্ছে। তবে, ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।’
পুলিশ ও ডিবি সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে কমপক্ষে ১৯ জন অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে অসুস্থ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার তথ্য আসে পুলিশের কাছে। এরপর জোরদার করা হয় পুলিশের তৎপরতা। যার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকদিন আগে এ ধরণের দুটি গ্রæপের সর্দারসহ অন্তত পাঁচ সদস্যকে তারা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। জব্দ করা হয়েছে অপরাধে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম ও উপকরণ। এর মধ্যে একটি ‘ভোলা গ্রæপ’ নামে পরিচিত বলে পুলিশের দাবি। গত ১৯ জুলাই নগরীর টাইগার পাস ও পুরাতন রেল স্টেশন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ গ্রæপের সর্দারসহ চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার চারজন হলেন, মো. চুন্নু (৩৬), মো. জসিম (৩২), নুর ইসলাম (৩৫) এবং মো. আকবর (৩৫)। তারা সবাই ভোলা জেলার লালমোহন থানার চর সখিনা গ্রামের বাসিন্দা।
কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান জানান, চুন্নুর নেতৃত্বে এ গ্রুপটি গত এক দশক ধরেই বিভিন্ন জেলা শহরে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়ার অপরাধ সংঘটিত করে আসছে। সাধারণত কোনও বাস যাত্রীকে টার্গেট করে চার জনের এই দলটি কৌশলে ওই যাত্রীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাকে ঘুমের ওষুধ মেশানো ফলের রস খেতে দিত। ওই যাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়লে তার সর্বস্ব হাতিয়ে নিত। এর মধ্যে একবার মুন্সিগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে এবং আরেকবার নোয়াখালীতে তারা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। চট্টগ্রামে তারা শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকেই টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেছে।
সিএমপির গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক মো. ইলিয়াছ খান জানান, গত ২০ জুলাই রাতে দেশে তৈরি একটি বন্দুক ও দুই রাউন্ড গুলিসহ নগরীর টাইগার পাস এলাকা থেকে মনির আহম্মেদ (৩৬) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মনির নগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ‘পুলিশ পরিচয়ে’ ছিনতাইয়ের অন্যতম হোতা। গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ি হাইদচকিয়া ইউনিয়নে হলেও একসময় থাকতেন নগরীর চকবাজার এলাকায়। বর্তমানে থাকেন নগরীর বন্দর থানার সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায়। চলতি বছরের গত ২১ মে খুলশী থানার ঝাউতলা এলাকায় ডিবি পরিচয়ে এক বাসযাত্রীর কাছ থেকে তিন লাখ ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার জাহেদ, আরিফ, মামুনসহ চারজন কারাগারে আছেন। এর মধ্যে মামুন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আহত হয়েছিলেন। মনিরের গ্রæপে সাদ্দাম, হারাধন, জাহেদ, রাজীব, আরিফ, বড় মিয়া, মামুনসহ আরও কয়েকজন আছেন। একসময় ব্যবসা করলেও তাতে লোকসান গুণতে থাকায় ২০১০ সালের দিকে ব্যবসা গুটিয়ে অপরাধে জড়ান তিনি। নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী বায়েজিদ এলাকার শাহাবউদ্দিনের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। ২০১১-১২ সালের দিকে দুইজন মিলে বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে অপরাধকর্ম শুরু করেন। ২০১৭ সালে হাটহাজারীতে ডিবি পরিচয়ে ৩১ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রথমবারের মত গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাকে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় ১১ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের মামলারও আসামি মনির। হাটহাজারী ও চান্দগাঁও থানার মামলায় প্রায় ছয় মাস কারাভোগ করে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি জামিনে মুক্তি লাভ করেন। এরপর বায়েজিদ এলাকায় সাড়ে নয় লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটান।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পশুরহাটের বেপারী থেকে শুরু করে ক্রেতা পর্যন্ত যে কাউকেই তারা টার্গেট করে। তবে, ছিনতাইয়ের সব ঘটনাতেই শিকার হওয়া ব্যক্তিকে আঘাত করা হয়না। কখনও চলতি পথে সালাম দিয়ে, কখনওবা যাত্রীবেশে অটোরিক্সায় তুলে চোখে মলম লাগিয়ে দিয়ে কিংবা অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে নিরীহ লোকজনের কাছ থেকে টাকাপয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই হয়রানি ও ঝামেলা এড়াতে থানায় অভিযোগ কিংবা মামলা করেন না। ফলে, থানাগুলোয় ছিনতাইয়ের মামলা রেকর্ড হয় কম। কেউ মামলা করতে থানায় গেলে তা জিডি হিসেবে রেকর্ড করার অভিযোগও রয়েছে। রাজনৈতিক লেবাসধারী পাড়া-মহল্লাভিত্তিক কথিত বড় ভাইয়েরাও এ ধরনের অপরাধ চক্রের নেপথ্যে রয়েছে।
সিএমপির হালনাগাদ তালিকায় এ ধরনের সন্দেহপ্রবণ শতাধিক স্পট রয়েছে। এর মধ্যে চকবাজার, কোতোয়ালি, সদরঘাট, বাকলিয়া থানায় রেেছ ৩০টি করে। একইভাবে খুলশী, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও বায়েজিদ থানা এলাকায়ও রয়েছে ৩০টি করে স্পট। এছাড়া, ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, হালিশহর ও আকবর শাহ্ থানা এলাকায় ২৪টি করে এবং বন্দর, ইপিজেড, পতেঙ্গা ও কর্ণফুলী থানা এলাকায় ২৭টি করে ছিনতাইপ্রবণ স্পট রয়েছে। ছিনতাইপ্রবণ স্পটগুলোকে ঘিরে টহল বাড়ানোর পাশাপাশি সাদা পোশাকে চলছে গোয়েন্দা নজরদারি করছে পুলিশ। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে নগরবাসীকে সন্ধ্যার পর নির্জন এলাকা এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।